দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে পেনশন সুবিধার আওতায় আনতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামী ১ জুলাই থেকে যারা নতুন করে সরকারি চাকরিতে ঢুকবেন তাদের জন্য পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এর বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, এ স্কিমে ঢুকলে শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

বর্তমান শিক্ষকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে ঢোকা বাধ্যতামূলক নয়, কেবল নতুনদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তারপরও আন্দোলনে নামছেন বর্তমান শিক্ষকরাই। তারা পেনশন স্কিম থেকে সব শিক্ষককে বাইরে রাখার দাবি জানাচ্ছেন।

সোমবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করার কথা রয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের। সেখানে পেনশন স্কিমের তালিকা থেকে শিক্ষকদের বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে সরকারকে সময় বেঁধে দেবেন শিক্ষক নেতারা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকার তাদের দাবি না মানলে, কঠোর আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেবেন তারা।

আন্দোলন-সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা বলছেন, সংশোধনের পর সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রায় ৪০০ সংস্থার ওপর কার্যকর হবে। যেসব সংস্থা ৫০ শতাংশের বেশি সরকারি অর্থায়নে চলে তাদের এই স্কিমের আওতায় আসতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন ১৪ লাখের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। নতুন পেনশন স্কিমে তারা ক্ষুব্ধ হলেও চাকরির ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। তারা সবাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। কারণ, তারাও আসলে পেনশন স্কিমে যেতে চান না।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিম্ন আয়ের মানুষ উপকৃত হলেও সরকারি চাকরিজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় চাইলেই আমরা আন্দোলনে নামতে পারি না। যারা আন্দোলন করবে তাদের প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ব্যানারে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন শিক্ষকরা। সোমবার সংবাদ সম্মেলনে করে পেনশন স্কিম থেকে শিক্ষকদের বাদ দেওয়ার জন্য সরকারকে শেষবারের মতো সময় বেঁধে দেবেন তারা। দাবি না মানলে চলতি সপ্তাহের শেষে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বর্জনসহ আরও কঠোর কর্মসূচি দেবেন তারা। শিক্ষকদের লক্ষ্য, আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগেই এটার একটা সুরাহা করা।

শিক্ষকদের বিরোধিতার নেপথ্যে

শিক্ষকদের দাবি, নতুন পেনশন স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা ৫৯ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরকালীন সময় ৬৫ বছর। কিন্তু নতুন স্কিমে অবসরকালীন বয়স ধরা হয়েছে ৬০ বছর। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বয়সসীমা কত হবে বা নতুন স্কিমে কীভাবে সামঞ্জস্য করা হবে সে ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

এ স্কিম নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রশংসনীয় হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। সরকারি কলেজসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এর বাইরে রয়েছে। সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ ও প্রশাসন এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সামনে শিক্ষকরা, পেছন থেকে সমর্থন দিচ্ছেন সবাই

শিক্ষকরা মনে করছেন স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেশন, সরকারি বিভিন্ন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্বজনীন পেনশন স্কিমে যুক্ত করার পর তাদের বেশির ভাগই সংক্ষুব্ধ। কিন্তু চাকরির ভয়ে তারা মুখ খুলছেন না। যেহেতু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেদের আইনে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তাদের চাকরিচ্যুতিতে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই, তাই শিক্ষকদের সামনে রেখে আন্দোলন করাতে চান তারাও। তাদের আন্দোলনে মৌন সমর্থন থাকবে ১৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর।

২০১৫ সালে ৮ম পে-স্কেলে শিক্ষকদের নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন গড়ে ‍ওঠে। সেই সময় ক্লাস বর্জনসহ কঠোর কর্মসূচির কারণে সরকার শিক্ষকদের সঙ্গে বসতে বাধ্য হয় এবং অনেক দাবি মেনে নেয়। এবারও সবার হয়ে তারা আন্দোলনে নামছেন এবং পূর্বের মতোই দাবি আদায় হবে বলে আশা করছেন শিক্ষকরা।

কী আছে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে

পেনশনের বাইরে থাকা ব্যক্তিদের পেনশনের আওতায় আনতে সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে। এ স্কিমের মূল উদ্দেশ্য নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষকে পেনশনের আওতায় নিয়ে আসা। ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। চলতি বছরের মার্চে পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে তাতে স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বশাসিত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার অন্তর্ভুক্তিকে বাধ্যতামূলক করা হয়।

নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, এসব সংস্থায় নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সবাইকে সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিমে যুক্ত হতে হবে। ফলে এই স্কিম প্রায় ৪০০ সংস্থার ওপর কার্যকর হবে। যেসব সংস্থা ৫০ শতাংশের বেশি সরকারি অর্থায়নে চলে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে এই স্কিমে আসতে বাধ্য করা হয়েছে। স্বশাসিত বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বোঝানো হয়েছে সেগুলোকে, যারা কোনো আইনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা। এর মধ্যে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, কমিশন, সংস্থা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউশন, কাউন্সিল, একাডেমি, ট্রাস্ট, বোর্ড, ফাউন্ডেশন ইত্যাদি রয়েছে।

এর বাইরে দুর্নীতি দমন কমিশন, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), জীবন বিমা করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ইত্যাদি রয়েছে এ তালিকায়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন ১৪ লাখের বেশি কর্মকর্তা কর্মচারী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আপত্তি কেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, এ স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। এই স্কিম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও শিক্ষকদের জন্য চরম অমর্যাদাকর। শিক্ষকরা বর্তমান ও নতুন স্কিমের তুলনামূলক একটি চিত্র দেখিয়েছেন। সেখানে তারা দাবি করেছেন, ১৩ ধরনের বৈষম্যের শিকার হবেন শিক্ষকরা।

শিক্ষকদের দাবি, একজন শিক্ষক সরাসরি উচ্চতর পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এমনকি অভ্যন্তরীণ প্রার্থীও নতুনভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। নতুন স্কিমের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন তারা। এছাড়া এককালীন টাকা, বোনাস ও পরিবারের সুরক্ষার অনেক জায়গায় বঞ্চিত হবেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক নতুন স্কিমে কীভাবে শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তার একটি চিত্র তুলে ধরে বলেন, বর্তমান পদ্ধতিতে একজন অধ্যাপকের অবসর সময়কালীন মূল বেতন থাকে ৭৮ হাজার টাকা। বিদ্যমান পেনশনে তার বেতন হতে পেনশন বাবদ কোনো অর্থ কর্তন করা হয় না। নতুন স্কিমে মূল বেতনের ১০ শতাংশ কর্তন হবে। মাসিক পেনশন হিসাবে আপনি অবসরকালীন বেতনের যে অর্ধেক পাবেন সেখানে এখন ১০ শতাংশ কম পাবেন।

তিনি বলেন, কেউ যদি ৩০ বছরেও শিক্ষকতায় যোগদান করে তার চাকরিকাল দাঁড়ায় ৩৫ বছর। সে যদি মাসিক ৫ হাজার টাকা মূল বেতন হতে কর্তন করে ৩৫ বছরে তা দাঁড়াবে ২১ লাখ টাকা। কিন্তু বর্তমানে তা শূন্য। বর্তমান পেনশন ব্যবস্থায় পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হন। কিন্তু নতুন স্কিমে পেনশনার আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হলেও তার মৃত্যুর পর নমিনির বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। এক্ষেত্রে নমিনি বৃদ্ধ বয়সে একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। আবার নমিনিও যদি পেনশনার হন, তাহলে উনি কি ডাবল বেনিফিট পাবেন? সেটা পরিষ্কার করা হয়নি।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, বর্তমানে নিট পেনশনের উপর ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলেও নতুন স্কিমে সেটি শূন্য। পেনশনারের ক্রয়ক্ষমতাকে বিবেচনায় না নিয়ে প্যাকেজসমূহ তৈরি কোনোভাবেই বাস্তবিক নয়। এক্ষেত্রে বিদ্যমান পেনশন স্কিমের সঙ্গে প্রত্যয় স্কিম সাংঘর্ষিক।

তিনি বলেন, বর্তমানে অর্জিত ছুটি অবসরকালীন জমা থাকলে তার পরিবর্তে অর্থ দেওয়া হয় কিন্তু নতুন স্কিমে এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। একজন সরকারি চাকরিজীবী এলপিআরে গেলে কী ধরনের সুবিধা পাবেন সে বিষয়েও কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

বিদ্যমান পেনশন স্কিমে মাসিক পেনশনের সঙ্গে চিকিৎসা ভাতা, বছরে দুটি উৎসব ভাতা ও ১টি বৈশাখী ভাতা দেওয়া হয়। কিন্তু নতুন স্কিমে এসব কোনো কিছুই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বর্তমানে প্রভিডেন্ট ফান্ড (পিএফ) থেকে ১০ শতাংশ কর্তন করা হয় কিন্তু পেনশন বাবদ কোনো অর্থ কর্তন করা হয় না। বর্তমান সুবিধা অব্যাহত রাখতে হলে ১০ শতাংশ হারে পিএফ চালু রাখতে হবে এবং ১০ শতাংশ হারে বা ৫০০০ টাকা যা কম তা কর্তনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ চাকরির শুরুর দিকে ২০ শতাংশ কর্তন চাকরিজীবীর জন্য বোঝা হয়ে যায় কি না তা ভাবার বিষয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আখতারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন পেনশন স্কিমে শিক্ষকদের টেনে এনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনকে অবমাননা করা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষক ও তাদের পরিবারকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে গত মার্চ থেকে  নানা কর্মসূচি পালন করছি। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করছে না। সামনে বাজেট, তার আগেই এটার সমাধান করতে হবে। না হয় কঠোর কর্মসূচি দেব আমরা।

ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন পেনশন স্কিমে শিক্ষকরা সম্মান ও আর্থিকভাবে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন অর্থ মন্ত্রণালয় ও সরকারের একাধিক সংস্থাকে আমরা তা বুঝিয়েছি। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেই। সোমবার এ স্কিমের নানা বৈষম্যের কথা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করব। এসব সমস্যা সমাধানে সময়সীমা বেঁধে দেব। না মানলে দ্রুত সময়ের মধ্যে বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা দেব। সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং মেধাবীরা এ পেশায় আসবে না।

এনএম/এসকেডি