নতুন কারিকুলামে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্প নিয়ে প্রতিবাদ করায় একাডেমিক কার্যক্রম থেকে সরিয়ে রাখা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির (আইইউবি) শিক্ষক অধ্যাপক ড. সরোয়ার হোসেনকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।

রোববার (২৮ জানুয়ারি) রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এ বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের মুখে অধ্যাপক সরোয়ার হোসেনকে ক্লাসে ফেরানোর দাবি মেনে নিয়েছে প্রশাসন। সোমবার (২৯ জানুয়ারি) থেকে তিনি ক্লাসে ফিরবেন বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।

জানা যায়, রোববার বেলা ১১টা থেকে ক্লাস বর্জন করে ক্যাম্পাসের ভেতরে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। পরে শিক্ষক অধ্যাপক সরোয়ার হোসেনকে ক্লাসে ফেরানোর আশ্বাসে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি তুলে নেন।

আন্দোলরত শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস থেকে কর্মকর্তারা এসে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। শিক্ষক অধ্যাপক সরোয়ার হোসেন আগামীকাল (সোমবার) থেকে ক্লাসে নিয়মিত হবেন বলে কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের মৌখিকভাবে জানিয়েছেন।

শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রশাসনের আশ্বাসে আমরা আন্দোলন আজকের মতো স্থগিত করেছি। তারা আমাদের ক্লাসে ফিরে যেতে বলেছেন। আমরা মনে করছি, আন্দোলন সফল হয়েছে। আমরা প্রশাসনের এমন আশ্বাস পর্যবেক্ষণ করছি। দাবি বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ব্যত্যয় দেখা গেলে অবশ্যই শিক্ষার্থীরা আবার মাঠে নেমে আসবে।

অধ্যাপক ড. সরোয়ার হোসেন ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন।

গত শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে নতুন কারিকুলামের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ের শরীফ থেকে শরীফা হওয়ার গল্পের অংশটুকু নিয়ে প্রতিবাদ করেন অধ্যাপক ড. সরোয়ার হোসেন। তার এ প্রতিবাদের ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে আর ক্লাসে না যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।

ওই অনুষ্ঠানে যা বলেছিলেন অধ্যাপক সারোয়ার

গত শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক : বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনার আয়োজন করে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম।

ওই সেমিনারে অধ্যাপক সারোয়ার বলেন, ‘ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে আপনাদের যদি ভেঙে ভেঙে বুঝাইতাম তাহলে আপনারা রাতে ঘুমাইতে পারবেন না। ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু মারাত্মক ইস্যু। আমি এ বিষয়ে ৬ বছর পিএইচডি করেছি।’

তিনি বলেন, ‘ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়কে আমার সন্দেহ হয়েছিল, তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু বুঝতে হলে জনস্বাস্থ্য বুঝতে হবে। তাহলে ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুটা বুঝতে পারবেন। সমকামিতা কোনো আলোচনার বিষয় না। এর কারণে কওমে লূত ধ্বংস হয়েছে। সব ধর্মে নিষিদ্ধ এ সমকামিতা। গতকাল শুনলাম আমার প্রতিষ্ঠান আমার জন্য পলিসি তৈরি করেছে। যেন চাকরি খেয়ে দিতে পারে। ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে যে কথা বলবে তার চাকরি খেয়ে দিতে পারবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। সপ্তম শ্রেণির বইতে শরীফ থেকে শরীফার গল্প আছে। মনে মনে নারী এবং মনে মনে পুরুষ, এটা ভয়ংকর জিনিস।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার লাইফ ঝুঁকির মধ্যে, আপনারা কি জানেন? আমার পেছনে অনেক লোক ঘুরছে। আমি বাইরে যেতে পারি না। আমাকে টার্গেট করে ওরা কমপ্লেইন করেছে, চাপে ফেলেছে। আমি বললাম এটা কীভাবে সম্ভব। আমরা জাতি গঠন করি। আমরা চাই সাসটেইনেবল সোসাইটি হোক, আমরা কি চাই অসুস্থ সোসাইটি হোক?’

প্রসঙ্গত, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণীত সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের একটি অধ্যায়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে একটি পাঠ রয়েছে। এ পাঠের বিষয়বস্তু নিয়ে বছরের শুরু থেকেই বিতর্ক চলছে। সম্প্রতি বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস’র একটি অনুষ্ঠানে বইয়ের ওই গল্পের পাতা ছিঁড়ে ফেলার পর।

বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘পাঠ্যবইয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক পাঠ অংশের উপস্থাপনায় কোনো বিতর্ক বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকলে এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করলে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে।’

‘বইয়ে শব্দটি ট্রান্সজেন্ডার নয়, থার্ড জেন্ডার’ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘সেটি আইনত স্বীকৃত, যারা জৈবিক কারণে তৃতীয় লিঙ্গ বা সামগ্রিকভাবে সমাজে হিজড়া নামে পরিচিত। তারা এ দেশের নাগরিক। অবশ্যই তাদের নাগরিক সুবিধা আছে।’

এরপর বুধবার (২৪ জানুয়ারি) পাঁচ সদস্যের গঠিত কমিটিতে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আব্দুর রশীদকে আহ্বায়ক করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন– ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর মুফতি মাওলানা কফিল উদ্দীন সরকার, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হালিম এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ।

এনএম/এসএসএইচ