দেশের ফাজিল-কামিল মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষাক্রম অনুমোদন, অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ নিয়োগ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, পরিদর্শন, মাদ্রাসা নবায়ন, পরীক্ষা পরিচালনাসহ সার্বিক তত্ত্বাবধান করে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিতর্ক যেন পিছুই ছাড়ছে না এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। নিয়োগে জালিয়াতির দায়ে সহকারী রেজিস্ট্রার ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস মো. জাকির হোসেন এবং উপ-রেজিস্ট্রার আবু হানিফাকে চূড়ান্ত বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে। ওই অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করবে বলে জানিয়েছে ইউজিসি।

জানা গেছে, উপ-উপাচার্য (প্রো-ভিসি) আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) ৯৭ পৃষ্ঠার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে। গত ২৫ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে মো. আশ্রাফ উদ্দিন তামিম নামে একজন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও শিক্ষা সচিবের কাছে তথ্য-প্রমাণসহ প্রো-ভিসির নানা অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির অভিযোগ জমা দিয়েছেন।

ইউজিসিতে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়েছে, আবুল কালাম আজাদ মাদ্রাসায় পরিদর্শন, অধিভুক্তি, প্রাথমিক পাঠদান, নবায়ন, তদন্ত, নিয়োগ প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণসহ নানা কাজে গেছেন। তিনি মাদ্রাসা অধিভুক্তি ও নবায়নে পরিদর্শনে গেলে গড় হিসেবে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নেন। আর প্রাথমিক পাঠদানের অনুমোদনের জন্য গেলে সেই টাকা গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল-ভাইস প্রিন্সিপাল নিয়োগে প্রতিনিধি হিসেবে গেলেও তাকে এক লাখ টাকার নিচে দিলে নেন না। এ ছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও টিএ/ডিএ নেন। তিনি গত বছরের জুন মাসেই শুধু টিএ/ডিএ খাতে ২ লাখ ৫০ হাজার ১৬৮ টাকা নিয়েছেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, তিনি নিয়ম অনুযায়ী প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ২০০ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু তিনি অনেক মাসেই ৩৫০ থেকে ৪০০ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি তেল নেন। তার বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার হলেও তিনি তা দেখান ১৫০ কিলোমিটার। এ ব্যাপারে তার ড্রাইভারকে শোকজও করা হয়েছে। এ ছাড়া তার জন্য বরাদ্দ করা ঢাকা মেট্রো-ঠ-১৩-৫৩১৬ গাড়ি থাকার পরও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবাস প্রায় সময়ই ব্যবহার করেন।

জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, এই বিলগুলো আমি যখন উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলাম তখনকার। উপাচার্যের তেলের কোনো সিলিং (নির্ধারিত) নেই।

নিজের জ্বালানি তেলের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার বাসার দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। ড্রাইভার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় যান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। অর্থাৎ দিনে চারবার আসা যাওয়ায় মোট ৬০ কিলোমিটার যেতে হয়। এ ছাড়াও অনেক রাষ্ট্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে নানা জায়গায় যেতে হয়। এজন্য ২২তম সিন্ডিকেট মিটিংয়ে আমার অতিরিক্ত তেলের বিষয়টি পাস করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদনেই তা ব্যবহার করেছি।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ড. আবুল কালাম আজাদ বিভিন্ন মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, ভাইস-প্রিন্সিপালসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগে প্রতিনিধি হিসেবে নিজেই নিজের নামে চিঠি ইস্যু করেন। বরিশালের বাঘিয়া আল আমিন কামিল মাদ্রাসায় প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগে বড় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেখান থেকে তিনি বড় অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের খোশবাজার ছালেহিয়া দারুচ্চুন্নাত কামিল মাদ্রাসার নিয়োগ প্রতিনিধি হিসেবে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি ঢাকায় কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগসাজশে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে তিনি ওই মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দেন। পটুয়াখালীর দুমকী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার গভর্নিং বডি অনুমোদন নিয়ে মামলা থাকার পরও তিনি তা অনুমোদন দেন। রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার পাইকান আকবরিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসা পরিদর্শনে নিজেই নিজের চিঠি অনুমোদন করেন। এমনকি নিজেই আবার নিজের টিএ/ডিএ বিল অনুমোদন করেন।

এ অভিযোগের ব্যাপারে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ঝালকাঠির এন এস কামিল মাদ্রাসা পরিদর্শনের জন্য দিনাজপুর ভবানীপুর আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হাসান মাসুদ, ভিসির পিএস আশফাক ও আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঠাকুরগাঁওয়ের খোশবাজার ছালেহিয়া দারুচ্চুন্নাতের অধ্যক্ষ নিজেই বলছেন, আমি রংপুর গিয়েছি। তাহলে কার অভিযোগ সত্য? স্থানীয় জেলা প্রশাসককে জিজ্ঞেস করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।

অভিযোগে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে বলা হয়, যোগদানের পর ১ বছর ১০ মাসে তিনি ৫০০টি মাদ্রাসার অধিভুক্তি নবায়ন ও ২০০টি মাদ্রাসা অধিভুক্তি বিষয়ে পরিদর্শন, ৫০টি মাদ্রাসা প্রাথমিক পাঠদান বিষয়ে পরিদর্শন, ১০০টি মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল, ভাইস-প্রিন্সিপালসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ প্রতিনিধি, ৮৫০টি মাদ্রাসা পরিদর্শনে টিএ/ডিএ বাবদ গ্রহণ ও প্রতি মাসে জ্বালানি বাবদ অতিরিক্ত ২০০ লিটার ব্যবহার থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অভিযোগে প্রো-ভিসির ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। আবুল কালাম আজাদ যোগদানের পর থেকে এক বছর ১০ মাসে ৭৯ লাখ ১০ হাজার ৮৪৭ টাকা জমা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ তিনি এসময়ে বেতন-ভাতা পেয়েছেন ২৫ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭০ টাকা। এ ছাড়া তার আরও তিনটি ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখলে বড় ধরনের লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যাবে বলেও অভিযোগে বলা হয়েছে। প্রো-ভিসির শেয়ার বাজারে বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে, তার ও স্ত্রীর নামে লাখ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রো-ভিসি বলেন, পুরো অভিযোগ মিথ্যা। দুই বছরে মাদ্রাসা পরিদর্শন করেছি কমবেশি ৫০টির মতো। সুতরাং ৯০০ মাদ্রাসা একক পরিদর্শন করেছি– এ অভিযোগ আদৌ সত্য নয়। মাদ্রাসা পরিদর্শনে কোনো মাদ্রাসা থেকে চাঁদাবাজি বা অর্থ গ্রহণ করিনি এবং গ্রহণের কোনো অভিযোগও নেই। পরিদর্শনে টিএ/ডিএ বাবদ প্রায় দুই বছরে সাড়ে চার লাখ টাকা পেয়েছি। এক মাসে ৪ লাখ টাকা টিএ/ডিএ নিয়েছি, তা পুরো মিথ্যা।

তিনি বলেন, অভিযোগকারীর নামের সঙ্গে তার ব্যবহার করা ফোন নম্বর ঠিক নেই। তার নাম আরিফুল ইসলাম, বাড়ি খুলনায়। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ না, কোনো মাদ্রাসায় কর্মরত না। তাহলে তার ইন্টারেস্ট কি?

আবুল কালাম আজাদ বলেন, আব্দুল্লাহ জোবায়ের নামের এক ব্যক্তি তার ফেসবুক ওয়ালে এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাকে বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর অফিসে প্রায়ই দেখা যায়। তার দাবি, ওই ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কারও প্ররোচনায় এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন।

তিনি জানান, বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে। এর পেছনে আমি থাকতে পারি, এমন সন্দেহ করা হচ্ছে। আমি এর পেছনে নেই, কেউ প্রমাণ করতে পারলে তাকে কোটি টাকা দেব।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. হাসিনা খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওনার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এটা আমলে নিয়ে তদন্ত করা হবে।

এনএম/এসএসএইচ