অভিযুক্ত শিক্ষক আবু সুফিয়ান

ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক আবু সুফিয়ানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। 

বুধবার (৬ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টায় ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) কেকা রায় চৌধুরী।

স্কুল সূত্রে জানা যায়, আজ (বুধবার) রাতে স্কুলের গভর্নিং বডির এক জরুরি সভায় অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে অভিযুক্ত আবু সুফিয়ানকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে তার বহিষ্কারাদেশ কার্যকর হবে। 

সূত্রে আরও জানা যায়, তদন্ত প্রতিবেদনে প্রাথমিক সত্যতা মেলায় অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আগামী শনিবার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে তার বিরুদ্ধে স্থায়ী বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এছাড়া স্কুলে বুলিং, যৌন হয়রানি সংক্রান্ত যে সকল কমিটি রয়েছে সেগুলোকে আরও অ্যাকটিভ করতে বলা হয়।

আরও পড়ুন- শিক্ষকের এসএমএসের ভাষা দেখে বোবা হয়ে যাই : ভিকারুননিসা ছাত্রীর মা

এ বিষয়ে কেকা রায় চৌধুরী বলেন, স্কুলের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে এক জরুরি সভায় অভিযুক্ত শিক্ষককে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এর আগে বুধবার রাত ৯টায় স্কুলে জরুরি সভা হয়। ভিকারুননিসার গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, স্কুলের অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী, অভিভাবক প্রতিনিধি, শিক্ষক প্রতিনিধিরা এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। 

সভায় গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ানের ইস্যু উত্থাপন করেন। সভায় তিনি জানান, ওই ছাত্রী ও অভিভাবকদের অভিযোগ পাওয়ার পরপরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ৮ দিন অভিযুক্ত, ভিকটিম ও তার পরিবার, বসুন্ধরা ও মূল শাখার এক ডজনের বেশি শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছে। এর মধ্যে শিক্ষককে দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদ করে তার বক্তব্যও রেকর্ড নেওয়া হয়।

তিনি আরও জানান, সবার সঙ্গে কথা বলে তদন্ত কর্মকর্তা ওই ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করার প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। তাই প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও ছাত্রী নিরাপত্তার স্বার্থে ওই শিক্ষককে বহিষ্কার করার জন্য সবার মতামত চান। ওই সময় গভর্নিং বডির অন্যান্য সদস্যরা তাকে বহিষ্কার করার পক্ষে মত দেন। এছাড়া স্কুলে যেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য শিক্ষকদের সতর্ক থাকার জন্য সভায় সিদ্ধান্ত হয়।

সভায় ওই ছাত্রীর নিরাপত্তায় যা যা করণীয় সে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলা হয়। ওই ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে তার লেখাপড়ায় যেন বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য যা যা করা দরকার সব করতে অধ্যক্ষকে বলা হয়। সে যদি অন্য শাখা বদলি হতে চায় সে ব্যবস্থাও নিতে বলা হয়।   

জানা গেছে, নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেছেন শিক্ষক আবু সুফিয়ান- এমন অভিযোগে গত ২৭ আগস্ট ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ওই ছাত্রীর বাবার। অভিযোগ আমলে নিয়ে ৩১ আগস্ট সহকারী কমিশনার আল আমিন হালদারকে তদন্তের দায়িত্ব দেন কমিশনার। এরপর ২ সেপ্টেম্বর (শনিবার) বসুন্ধরা শাখার ১০ জন শিক্ষক, শাখা প্রধান, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নেন তদন্ত কর্মকর্তা। এরপর মঙ্গলবার ভিকটিম ওই ছাত্রীর বক্তব্য গ্রহণ করে কমিটি।

সর্বশেষ আজ বুধবার অভিযুক্ত শিক্ষক আবু সুফিয়ানের বক্তব্য গ্রহণ করে তদন্তের কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর রাতে জরুরি সভা ডাকা হয়।

আরও পড়ুন : ভিকারু‌ন্নিসার সা‌বেক অধ‌্যক্ষের দুর্নীতি অনুসন্ধা‌নে দুদক

লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী ছাত্রীর বাবা উল্লেখ করেন, ‘আমার মেয়ে ভিকারুননিসা স্কুলের বসুন্ধরা শাখার নবম শ্রেণির দিবা শাখার ছাত্রী। ওই শাখার ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক আবু সুফিয়ানের কাছে সে প্রাইভেট পড়তে যেত। ওই শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানোর ফাঁকে বিভিন্ন সময় আমার মেয়েকে অশালীন খুদেবার্তা (এসএমএস) পাঠিয়েছে, যেগুলো খুবই আপত্তিকর ও সম্মানহানিকর। একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করা যায় না। আমি এ ঘটনার প্রতিকার চাই।’

শুধু ছাত্রী নয়, মায়েদেরও টার্গেট করতেন শিক্ষক সুফিয়ান!

ভিকারুননিসার বসুন্ধরা শাখার কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষক আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে ওই স্কুলের প্রাথমিক স্তুরের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। এরপর তাকে অন্য শাখায় বদলি করা হয়। তার বদলি ঠেকাতে শিক্ষার্থীদের দিয়ে আন্দোলন শুরু করান আবু সুফিয়ান। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বসুন্ধরা শাখার ইনচার্জ জগদীশ চন্দ্র পালের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন। বাধ্য হয়ে তার বদলির আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

বসুন্ধরা দিবা শাখার এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে শুধু ছাত্রী নয়, নারী শিক্ষক ও ছাত্রীদের মায়েদের সঙ্গেও আপত্তিকর আচরণ ও কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগ যখনই সামনে আসত বা কর্তৃপক্ষ আমলে নিতো, তখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামানোর হুমকি দিতেন আবু সুফিয়ান। শিক্ষার্থীরা না বুঝে তার ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোলন শুরু করত।

তিনি আরও জানান, ছাত্রীদের অল্প বয়সী মায়েরা আবু সুফিয়ানের টার্গেটে থাকতেন। তাকে প্রায়ই বসুন্ধরা এলাকায় ছাত্রীর মায়েদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খেতে দেখা যায়। এছাড়া তিনি অনুমতি ছাড়াই শিক্ষার্থীর বাসায় চলে যেতেন। এসব বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে অধ্যক্ষকে জানানো হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর ফলে তিনি আরও সাহস পেয়ে যান।

আরও পড়ুন : ভিকারুননিসার এক প্রশ্নপত্রে ৩০ ভুল!

জানা গেছে, গত বছর অভিযুক্ত শিক্ষক আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পান একই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শাখার এক শিক্ষক। সেই শিক্ষককে অপমান ও হেনস্তার হুমকি দেন আবু সুফিয়ান। ফলে তিনি আর তদন্ত কাজ করেননি।

হুমকি পাওয়া ওই শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি তদন্তের জন্য বসুন্ধরা শাখায় যাচ্ছিলাম। সেখানে গেলে আমি সম্মান নিয়ে ফিরে আসতে পারব না—এমন হুমকি দেওয়া হয়। এরপর আমি মাঝপথ থেকে ফিরে আসি। তার বিরুদ্ধে শুধু ছাত্রী নয়, ছাত্রীদের মায়েদেরও যৌন হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে।’

এ বিষয়ে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, গভর্নিং বডির আশকারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন বেড়েই চলছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠিয়ে বাসায় নিরাপদ থাকতে পারেন না। এসব শিক্ষক নামধারী চরিত্রহীন লম্পট শিক্ষকদের কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যেন অন্যরা দেখে ভয় পায়‌। 

প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১১ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা শিক্ষক পরিমল জয়ধর ওই প্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০১৫ সালে আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

এনএম/এমজে