দুটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে (ছাপাখানা) অস্বাভাবিক কাজ দেওয়া, নির্ধারিত সময়ে বই না দেওয়ার পরও জরিমানা না করা, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে সক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কাজ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি। এসব অনিয়ম, দুর্নীতি, কারসাজির সঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান-উৎপাদন নিয়ন্ত্রক সরাসরি জড়িত বলে দাবি করে তাদের অপসারণ চেয়েছে সংগঠনটি।

বৃহস্পতিবার (২২ জুন) নয়াপল্টনে মুদ্রণ শিল্প সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনীয়াবাত। এসময় বিভিন্ন স্তরের ছাপাখানার মালিকরা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যপুস্তক শিক্ষাক্রম বোর্ডের সহযোগিতায় সক্ষমতার চেয়ে অধিক কার্যাদেশপ্রাপ্ত অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস এবং কচুয়া প্রেস নামে দুইটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের বই সরবরাহ করে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে বই পৌঁছানোর কথা থাকলেও তা এপ্রিল, মে মাসে পৌঁছায়। দেরিতে বই দেওয়ার জন্য অন্যান্য মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান জরিমানার মুখে পড়লেও অদৃশ্য কারণে এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে এক টাকাও জরিমানা করা হয়নি। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৪ থেকে ৫ মাস দেরিতে বই দেওয়ার পরও এনসিটিবি সফটওয়্যার জালিয়াতির মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের বই ডিসেম্বরে ডেলিভারি দেখায়। এই পুরো জালিয়াতির সঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান-উৎপাদন নিয়ন্ত্রক জড়িত।

শহীদ সেরনীয়াবাত বলেন, মুদ্রণ শিল্প সমিতির কোন আলোচনা ছাড়াই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে দরপত্র সংশোধন করে চেয়ারম্যান। এতে মুদ্রণ সক্ষমতার সংজ্ঞা পরিবর্তন করে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে দুইটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে সক্ষমতার অধিক কাজ দেওয়া হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটি ৪-৫ মাস পর বই দেয়। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২১ থেকে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের সকল অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল অগ্রণী ও কচুয়া প্রিন্টার্স। পুরো সময় ধরে তারা ছিল সংবাদমাধ্যমের আলোচিত প্রতিষ্ঠান। গত শিক্ষাবর্ষে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত বই ৮০ জিএসএম এর স্থলে ৬০ জিএসএম দিয়ে ছাপানো হয়। যা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। তারা শেষ সময় নিজস্ব প্রেসে বই না ছাপিয়ে অন্য প্রেসে বই ছাপায়। এগুলো এনসিটিবি জানার পরও ছিল নীরব। এছাড়া অগ্রণী প্রিন্টার্স নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করে বই ছাপায়। এখন এনসিটিবির যাবতীয় অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়েছে।

এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিবাদ জানায় মুদ্রণ সমিতি। কিন্তু চেয়ারম্যানের স্পষ্ট জবাব এটা উপরের (ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ) নির্দেশ, তা অমান্য করার ক্ষমতা আমার নেই। চেয়ারম্যানের এ ধরনের বক্তব্যে অনিয়ম ও দুর্নীতি আরও সম্প্রসারণ হবে। বর্তমান সরকারের শিক্ষাবর্ষের ১ম দিনে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং শিক্ষাখাতে সরকারের অর্জিত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি সরকারের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবোধক করা হয়েছে। তাই অবিলম্বে দুর্নীতির আশ্রয়দাতা চেয়ারম্যান ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রকের অপসারণ চাই ।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এবার নির্বাচনী বছর। সময়মতো বই না দিতে পারলে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। অগ্রণী প্রিন্টার্সকে গত বছর প্রাথমিকের ১০ কোটি বইয়ের মধ্যে ৪ কোটি বইয়ের কাজ দেওয়া হয়। সক্ষমতার চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি কাজ দেওয়ায় চারমাস পর বই হস্তান্তর করে প্রতিষ্ঠানটি। এবার তাকে প্রায় ৭ কোটি বই দেওয়ার সব প্রস্তুতি সেরে রেখেছে এনসিটিবি। এমনটা হলে তারা আগামী বছরজুড়ে বই দিতে থাকবে। শিক্ষাবর্ষ শেষ হয়ে যাবে তবুও তাদের বই দেওয়া শেষ হবে না।

বিনামূল্যের বই ছাপার সঙ্গে যুক্ত বেশিরভাগ প্রিন্টার্স প্রতিষ্ঠান রাজধানী ও এর আশেপাশে। কিন্তু অগ্রণী প্রিন্টার্সের অফিস নোয়াখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এর আগে এ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছে এনসিটিবি ও পরিদর্শন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। গত বছর এ প্রতিষ্ঠান কোন কাগজ দিয়ে বই ছাপিয়েছে কি করেছে তারও কোন মনিটরিং হয়নি। এবারও তাই হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। এতে শিক্ষার্থীরা এবারও নিম্নমানের বই পাবে।

সংবাদ সম্মেলনে চলতি বছরে দরপত্রের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জানানো হয়, প্রাথমিকে দুটি কোডে বইয়ের দরপত্র দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৯৮ লটের মধ্যে ৯৯ শতাংশ এবং ৩৪৫ কোডের দরপত্রে প্রায় ৫৫ শতাংশ কাজ অগ্রণী প্রিন্টার্স পেয়েছে। এরকম হলে একসময় আড়াই শতাধিক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের এই সেক্টর দুই-তিনটি মুদ্রণকারীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে। এতে মুদ্রণকারীরা বেকার হওয়ার পাশাপাশি এর সঙ্গে যুক্ত কয়েক লক্ষাধিক কর্মচারীও কাজ হারাবে। তাই বিনামূল্যের বই ছাপার কাজের মাধ্যমে মুদ্রণশিল্পকে যেমন বাঁচিয়েছিলেন তেমনি এই দুটি প্রতিষ্ঠানের জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার করে এ শিল্পকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান তারা।

সংবাদ সম্মেলনে চার দফা দাবি জানানো হয়-

১. ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের দরপত্রে দুইটি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান মেশিনের বিপরীতে তার বহুগুণ বেশী কার্যাদেশ দেওয়ার অপচেষ্টা বন্ধ করা,

২. বিগত শিক্ষাবর্ষের অনিয়ম, দুর্নীতির সহায়ক ও আশ্রয়-প্রশয়দাতা এনসিটিবির চেয়ারম্যান-উৎপাদন নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া,

৩. উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি করে অগ্রণী এবং কচুয়া প্রেসের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিচার এবং তাদের সক্ষমতার বহুগুণ বেশী কাজ প্রদানে অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া,

৪. তদন্ত চলাকালে বোর্ডের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আনন্দ প্রিন্টার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রব্বানী জব্বার বলেন, এবার সবমিলিয়ে ৭০ দিন সময় পাওয়া যাবে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান যদি প্রাথমিক-মাধ্যমিক মিলিয়ে ১০ কোটি বইয়ের কাজ পায়, সে যত বড় প্রতিষ্ঠানই হউক, কোনোভাবেই সময়মতো বই দেওয়া সম্ভব না। সময়মতো বই দিতে হলে এ প্রতিষ্ঠানকে প্রতিদিন ১২ লাখ বই ছাপাতে হবে। আধুনিক মেশিনে প্রিন্ট যদিও সম্ভব হয় তাহলে বাঁধাই করা কোনোভাবেই সম্ভব না।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- মুদ্রণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জহুরুল ইসলাম, সমিতির সাবেক চেয়ারম্যান ও আনন্দ প্রিন্টার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রব্বানী জব্বার, আগামী প্রিন্টার্সের কর্ণধার ওসমান গণি প্রমুখ।

এনএম/এমজে