সরকার-রাষ্ট্রবিরোধী মন্তব্য
ফেসবুক নজরদারিতে প্রাথমিকের সাড়ে ৪ লাখ শিক্ষক
>> ফেসবুক মনিটরিংয়ে অধিদপ্তরের ৮ সদস্যের কমিটি
>> আপত্তিকর তথ্য প্রতি মাসের জমা দেওয়ার নির্দেশনা
বিজ্ঞাপন
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় সাড়ে চার লাখ শিক্ষকের ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নজরদারির উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের আট কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি নিয়মিত এটি নজরদারি করবে। কমিটি শিক্ষকদের ফেসবুকে আপত্তিকর বিষয়গুলো চিহ্নিত করে প্রতি মাসে মহাপরিচালকের কাছে প্রতিবেদন আকারে জমা দেবে। এরপর চিহ্নিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম গত ৯ এপ্রিল এ সংক্রান্ত কমিটি গঠন করে দেন। কমিটিকে প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। কমিটির সদস্য উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে উল্লেখযোগ্য কিছু থাকলে তা চিহ্নিত করে প্রতি এক মাস পরপর তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে চার লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। কতজন শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন তার সঠিক সংখ্যা অধিদপ্তরের কাছে না থাকলেও কর্মকর্তাদের ধারণা প্রায় সব শিক্ষকই ফেসবুক ব্যবহার করেন।
কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ডিপিই প্রশাসন শাখার সহকারী পরিচালক আব্দুল আলীমকে। সদস্য সচিব করা হয়েছে সাধারণ প্রশাসন শাখার গবেষণা কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমাকে। বাকি সদস্যরা হলেন- পলিসি অপারেশন গবেষণা কর্মকর্তা এস এম মাহবুব আলম, সাধারণ প্রশাসন শাখার শিক্ষা অফিসার আজহারুল ইসলাম ও মাজেলা সুলতানা, আইএমডির সহকারী মেইনটেন্যান্স অফিসার আব্দুল জব্বার, অর্থ রাজস্ব বিভাগের আ ফ ম জাহিদ হাসান ও ডকুমেন্টেশন সেন্টারের শিক্ষা অফিসার ফজলে এলাহি।
আরও পড়ুন >> একসঙ্গে ঈদ বোনাস ও বৈশাখী ভাতা পাচ্ছেন পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী
কমিটির আহ্বায়ক আব্দুল আলীম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিটি কী করবে তা চিঠিতে বলা হয়েছে। কমিটি গঠনের পর এখনও পূর্ণাঙ্গ কমিটির বসা হয়নি। বসে কোন পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হবে তা ঠিক করব।
জানা গেছে, ১৫ রমজান পর্যন্ত নয় কার্যদিবস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ছিল। এতে সরকার, মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তিদের তুলোধুনো করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করেন প্রাথমিকের কিছু শিক্ষক। সমালোচনা এক সময় রাজনৈতিক পর্যায়ে চলে যায়। বিষয়টি প্রাথমিক অধিদপ্তরের (ডিপিই) নজরে আসার পর শিক্ষকদের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে আরও সতর্ক হওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়। এ নোটিশের তুমুল সমালোচনা করেন শিক্ষকরা। সরকারি চাকরিজীবী হয়েও কেন শিক্ষকদের থামানো যাচ্ছে না তা জানতে চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বাধ্য হয়ে এবার শিক্ষকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী লিখছেন তা নজরদারি করতে কমিটি করে ডিপিই। কমিটি প্রাথমিকের প্রায় চার লাখ শিক্ষকের ফেসবুক নজরদারি করবেন এবং সরকার, রাষ্ট্র বা তার দপ্তরের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে তা চিহ্নিত করে প্রতিবেদন আকারে জমা দেবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সরকারি চাকরিজীবীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী করতে পারবেন, কী পারবেন না তা নির্ধারণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এরপর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবেও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের নিয়মনীতি দিয়েছে। তারপরও শিক্ষকদের থামানো যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন >> তদবিরের চাপ ঠেকাতে ফোন বন্ধ রাখছেন প্রতিমন্ত্রী-সচিব-ডিজি
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাকালীন শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে ১৫ রমজান পর্যন্ত প্রাথমিক স্কুল খোলার রাখার সিদ্ধান্ত হয়। অন্যান্য স্তরে বন্ধ থাকলেও প্রাথমিক স্কুল খোলা রাখায় মন্ত্রণালয়ের প্রতি নাখোশ হন শিক্ষকরা। তারা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা শুরু করেন। সমালোচনা করতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের রাজনৈতিকভাবে হেয় করেন। বিষয়টি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নজরে আসার পর নড়েচড়ে বসে অধিদপ্তর। শিক্ষকদের এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে নোটিশ দেওয়া হলেও সাড়া মেলেনি। বরং নোটিশের বিরুদ্ধে আরও বেশি সমালোচনা করতে থাকেন অনেক শিক্ষক।
যেভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে
প্রাথমিক পর্যায়ে চার লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। কতজন শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন তার সঠিক সংখ্যা অধিদপ্তরের কাছে না থাকলেও কর্মকর্তাদের ধারণা প্রায় সব শিক্ষকই ফেসবুক ব্যবহার করেন।
আরও পড়ুন >> কাড়ি কাড়ি টাকার ভাগ পেতে গুচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু শিক্ষক
কমিটির একজন সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তারা সব শিক্ষকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তদারকি করবেন। সেখানে আপত্তিকর, রাষ্ট্র বা প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু পেলে আমাদের কাছে স্ক্রিনশটসহ উপস্থাপন করবেন। এছাড়া শিক্ষকদের তথ্য সংগ্রহ করতে শিক্ষকদেরও ব্যবহার করা হবে। এজন্য প্রতি উপজেলায় কয়েকজন শিক্ষককে পেইড এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। তারা শিক্ষকদের তথ্য সংগ্রহ করে আমাদের কাছে সরবরাহ করবেন।
সরকারি চাকরিজীবীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী করতে পারবেন, কী পারবেন না তা নির্ধারণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এরপর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবেও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের নিয়মনীতি দিয়েছে। তারপরও শিক্ষকদের থামানো যাচ্ছে না।
কমিটির অপর সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের একাধিক ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষক এসব গ্রুপে যুক্ত। তারা সেখানে বেশি সোচ্চার। তথ্য সংগ্রহ করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হবে এসব গ্রুপ। এছাড়া যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ খুলেছেন, সেসব গ্রুপের অ্যাডমিন, গ্রুপের কনটেন্ট ও পোস্ট অনুমোদন যারা করছেন তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
ফেসবুকে যেসব নির্দেশনা মানতে হবে
শিক্ষকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে প্রাথমিকের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আটটি বিষয় তুলে ধরে তাদের সতর্ক করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। গত ৩০ মার্চ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মামুনুল আলম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ আট দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেগুলো হলো-
১. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, এমন কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, মন্তব্য, লাইক ও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
২. জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থি কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩. কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এমন বা ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির পরিপন্থি কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে— এমন কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, মন্তব্য, লাইক, শেয়ার করা থেকেও বিরত থাকতে হবে।
৪. জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো সার্ভিসকে হেয়প্রতিপন্ন করে—এমন কোনো পোস্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫. লিঙ্গ বৈষম্য বা এ সংক্রান্ত বিতর্কমূলক কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রচার করা যাবে না।
৬. জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে— এমন বিষয়ে লেখা, অডিও বা ভিডিও প্রকাশ বা শেয়ার করা যাবে না।
৭. ভিত্তিহীন, অসত্য বা অশ্লীল তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে।
৮. অন্য কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য সংবলিত কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, মন্তব্য, লাইক, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
এনএম/জেএস/এমআর/এসকেডি