এক উপাচার্যের বিস্ফোরক মন্তব্য
কাড়ি কাড়ি টাকার ভাগ পেতে গুচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু শিক্ষক
শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘব এবং আর্থিক সাশ্রয়ের জন্য ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিতভাবে ভর্তিতে গুচ্ছ পদ্ধতি চালু করা হয়। দুই বছর না যেতেই এ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা থেকে বের হয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) কর্তৃপক্ষ। একই পথে হাঁটছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)।
সম্প্রতি গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে নেওয়া সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন করে শিক্ষক সমিতি। এর আগে গুচ্ছের পক্ষে কথা বলায় এক শিক্ষককে অপদস্থ করার অভিযোগ উঠে শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
বিজ্ঞাপন
আগামী শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতি থাকবে কি থাকবে না এমন দোলাচলের মধ্যে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মো. মাহফুজুল ইসলাম।
রোববার (৯ এপ্রিল) সন্ধ্যায় বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই অধ্যাপক তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেইজে গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যেতে চায় এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কড়া সমালোচনা করে একটি স্ট্যাটাস দেন।
সেখানে তিনি বলেন, গুচ্ছ পদ্ধতিতে যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ফরমের কাড়ি কাড়ি টাকা উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেউ কেউ সংক্ষুব্ধ। তাই তারা এখন গুচ্ছের বিপক্ষে। এসব শিক্ষকের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখেন তিনি। প্রশ্ন তোলেন গুচ্ছ নিয়ে শিক্ষকদের নিজেদের চালানো জরিপ নিয়েও।
স্ট্যাটাসে যা বলেছেন এই উপাচার্য :
‘গুচ্ছে থাকা কিংবা না থাকা - অর্থ না বিবেক?
আগে অল্প কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, তখন গুচ্ছ পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল না। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে যদি এই ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে হয় আর প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ফি ১৫০০ টাকা করে পঞ্চাশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফি দিতে হবে ৭৫০০০ (পঁচাত্তর হাজার) টাকা, প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত ও থাকা খাওয়ার খরচ গড়ে ২০০০ টাকা করে হলেও একজন শিক্ষার্থীকে এ বাবদ খরচ করতে হবে আরো এক লাখ টাকা। ভোগান্তির কথা না হয় বাদই দিলাম। একজন শিক্ষার্থীকে প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ করতে হবে ভর্তিযুদ্ধ নামে জুয়া খেলায় অংশ নেওয়ার জন্য অথবা হাল ছেড়ে দিতে হবে অসহায় হয়ে।
যেসব বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা নেয়, স্বীকার করুক আর নাই করুক– এটা তাদের একটা বড় অংকের অর্থ এনে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি ১৫০০ টাকা হলে এবং ৫০০০০ (পঞ্চাশ হাজার) ছাত্রছাত্রী ভর্তি পরীক্ষা দিলে মোট আয় দাঁড়ায় ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ভর্তি পরীক্ষার খরচ ছাত্রপ্রতি গড়ে ১০০ টাকা (শিক্ষকদের পরিশ্রম ও খাওয়া-দাওয়া বাদে) হলে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাগাভাগির অংশ ৭ কোটি টাকা। শিক্ষকপ্রতি আয় ৫০-৬০ হাজার থেকে শুরু করে ২ থেকে ৩ লাখ টাকায় গিয়ে পৌঁছে। এটি লোভনীয় হতেই পারে।
গুচ্ছে থাকলে শিক্ষকদের এই ভাগটা অনেক কমে যায়। কিন্তু একবার ভাবুন তো, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত। অনেকে গরিব। আর এই গরিব নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েদের অসহায় করে অর্জিত এই টাকা কতটা বিবেক সচেতন আয়? আপনি একবার ভাবেন তো, কতজন গরিব ছেলেমেয়ে আপনার-আমার এই আয়ের কারণে পরীক্ষা দেওয়া থেকে বঞ্চিত হয়– একটি বা দুটি পরীক্ষা দিয়ে অসহায় হয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকে। সৃষ্টিকর্তা তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে যদি প্রাকৃতিক প্রতিশোধ নেয় তবে কি করার থাকবে আমাদের?
যারা গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যেতে চান, তারা শিক্ষকদের মধ্যে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেন। কি হাস্যকর, তাই না? শিক্ষকরা কেন গুচ্ছের পক্ষে মত দেবে– কেউ কি ব্যাখ্যা করে বলতে পারবেন? জরিপ চালাতে হলে ছাত্রদের মধ্যে জরিপ চালান, অভিভাবকদের মধ্যে জরিপ চালান। কেউ হয়ত দাবি করবেন যে, শিক্ষকরা বিবেক সচেতন– ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে জরিপে উত্তর দেন।
তাদের যুক্তি বড়ই ঠুনকো। তাহলে কোন যুক্তিতে বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে একজন ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে ১ ঘণ্টার এমসিকিউ পরীক্ষার ফি ১৫০০ টাকা নেন, কোন যুক্তিতে একজন ছাত্রছাত্রীকে ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ঠেলে দেন? আপনার বিবেক কেন নাড়া দেয় না?
গুচ্ছ পরীক্ষায় সমস্যা থাকতে পারে, যদি থাকে তার দায়দায়িত্ব কিন্তু শিক্ষকদেরই। আপনারা সবাই মিলে কেন একটা গ্রহণযোগ্য শিক্ষার্থীবান্ধব গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করতে পারছেন না? কোনটা অভাব আপনাদের– জ্ঞান নাকি সদিচ্ছা?
গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যাওয়া কোনো বীরত্ব নয়, নিজ স্বার্থে লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। আপনি হয়ত ভাববেন, আপনি গুচ্ছে থাকবেন না অন্যরা থাকুক। তাহলে মনে রাখতে হবে, কেউ দেশপ্রেমিক হলে তার অংশ কিন্তু আপনার প্রাপ্য নয়। গুচ্ছ থেকে সরে গেলে আপনার শ্রেষ্ঠত্ব নয়, বরং আপনার দেশপ্রেমে দেউলিয়াত্বই কেবল প্রকাশিত হয়।’
ফেসবুক স্ট্যাটাস সম্পর্কে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মাহফুজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে গুচ্ছ নিয়ে শিক্ষকদের একটি অংশ ষড়যন্ত্র করছে। শিক্ষামন্ত্রী যেখানে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, সেখানে জগন্নাথ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ যারা গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যেতে চায় তাদের উদ্দেশ্য কি? দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যেমন– নিজেদের আইডেন্টিটি রক্ষা করা, অন্যটি হলো অর্থ উপার্জন। যারা গুচ্ছ থেকে বের হতে চায় তারা প্রথমটি নয়, দ্বিতীয়টি নিয়েই ব্যস্ত। ফেসবুক স্ট্যাটাসটি জেনে বুঝেই দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ভর্তি ফরম বিক্রি বাবদ যে টাকা আয় হয় তার ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় সমপরিমাণ টাকা ফান্ডে না রেখে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের একাধিক অডিট রিপোর্টে দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই ফান্ডের টাকা শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করার প্রমাণ পেয়েছে।
এনএম/এসএসএইচ/