· ক্ষোভে ফুঁসছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা

· আদালতে যাওয়ার হুমকি

উপজেলা রিসোর্স সেন্টারে (ইউআরসি) কর্মরত ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের ‘সহকারী ইন্সট্রাক্টর’ পদে দায়িত্ব দিয়ে তাদের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সম্প্রতি এমন একটি চিঠি ইস্যু করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এরপর থেকে প্রাথমিকের শিক্ষকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সেই চিঠি। যা শিক্ষকদের ফেসবুক আইডিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। 

বিষয়টি নিয়ে চরম আপত্তি তুলে শিক্ষকরা বলছেন, এসএসসি পাস একজন কর্মচারী স্নাতক/স্নাতককোত্তর করা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন। এর চেয়ে অপমান ও লজ্জার বিষয় কী হতে পারে। দ্রুত এই চিঠি বাতিল করতে হবে, তা না হলে আদালতের শরণাপন্ন হব। 

জানা গেছে, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা নিতে গত ২০ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি ইস্যু করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সংস্থাটির মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সই করা ওই চিঠিতে উপজেলা রিসোর্স সেন্টারে (ইউআরসি) কর্মরত ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের ‘সহকারী ইন্সট্রাক্টর’ পদে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে একটি চিঠি পাঠান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। সেখানে বলা হয়, বিভিন্ন জেলা রিসোর্স সেন্টারে কর্মরত ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা থানা/উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের সহকারী ইন্সট্রাক্টরের বিদ্যমান শূন্য পদে চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন। 

আরও পড়ুন>>প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের ফল প্রকাশের সময় পেছাল

শিক্ষকদের অভিযোগ, গ্রেড বিচারে ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের তুলনায় কয়েক গ্রেড ওপরে রয়েছেন শিক্ষকরা। ফলে, কীভাবে ও কোন কাঠামো বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তারা তা জানতে চান। 

সরকারের এমন উদ্যোগের পেছনে কোনো ‘উদ্দেশ্য’ থাকতে পারে জানিয়ে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইউআরসির ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা ‘নন অ্যাকাডেমিক পদধারী’ হিসেবে কোনোভাবেই ‘অ্যাকাডেমিক ট্রেইনার’ ও ‘অ্যাকাডেমিক সুপারভাইজার’র কোনো পদে চলতি দায়িত্ব বা পদোন্নতি পেতে পারেন না— এটি অযৌক্তিক। এটা দ্রুত সময়ের মধ্যে বাতিল করতে হবে। তা না হলে প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন শিক্ষকরা।

চিঠিতে যা আছে:

গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে একটি চিঠি পাঠান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। সেখানে বলা হয়, বিভিন্ন জেলা রিসোর্স সেন্টারে কর্মরত ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা থানা/উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের সহকারী ইন্সট্রাক্টরের বিদ্যমান শূন্য পদে চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন।

ইউআরসির ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের পদগুলো ১৯৯৮ সালে আইডিয়াল ও নোরার প্রকল্পের অধীনে সৃষ্ট এবং ১৬তম গ্রেডের একটি পদ। বিদ্যমান ১৯৮৫ সালের নিয়োগবিধিতে এই পদ নেই ও অদ্যাবধি কোনো নিয়োগবিধিও চূড়ান্ত হয়নি। ফলে তারা ১৯৯৮-২০০৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ১৯-২৫ বছর যাবৎ একই পদে কর্মরত আছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার পার্সোনেল নিয়োগবিধি/২০১১-এর নম্বর ৪-আইন/২০১৯ অনুযায়ী ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা হলে ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের সহকারী প্রোগ্রামারের ৬০ শতাংশ পদে পদোন্নতির বিধান রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় উপজেলার উপ-শিক্ষা অফিস, জেলা প্রাথমিক পিটিআই ও বিভাগীয় উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে সহকারী প্রোগ্রামারের কোনো পদ নেই।

আরও পড়ুন>>প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দিতে হাইকোর্টের রুল

বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে ৪২৪টি থানা উপজেলা রিসোর্স সেন্টারে সহকারী ইন্সট্রাক্টরের পদ শূন্য রয়েছে। তার মধ্যে ইন্সট্রাক্টর পদে চলতি দায়িত্বে কর্মরত আছেন ১৫০ জন সহকারী ইন্সট্রাক্টর। প্রস্তাবিত নিয়োগবিধি (প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গেজেটেড ও নন গেজেটেড কর্মচারী নিয়োগবিধিমালা-২০১১) অনুযায়ী সহকারী ইন্সট্রাক্টর পদটি ১০ম গ্রেডের পদ ও নিয়োগ পদ্ধতি অনুযায়ী ২০ শতাংশ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে ও ৮০ শতাংশ পদ ফিডার পদ হিসেবে প্রধান শিক্ষকদের (বিভাগীয় প্রার্থী) জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা হবে কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিসহ বিএ ডিগ্রি অথবা যেকোনো বিষয়ে ২ শ্রেণিতে ৪ বছর মেয়াদি স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি সহকারী ইন্সট্রাক্টর ও প্রধান শিক্ষক উভয় পদই ২য় শ্রেণির মর্যাদাভুক্ত।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুযায়ী, জ্যেষ্ঠতা নির্ণয়ে জটিলতা, নিয়োগবিধি প্রণয়নে বিলম্ব, পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা/কর্মচারীর অভাব ও নিয়োগবিধি অনুযায়ী নিয়োগে বিলম্ব হলে ব্যতিক্রমধর্মী ক্ষেত্রে চলতি দায়িত্ব দেওয়া যায়। এছাড়াও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ তারিখের জারি করা একটি পরিপত্রেও সরকারি কর্মচারীদের অতিরিক্ত দায়িত্ব/চলতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পদের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার চেয়ে কম যোগ্যতা সম্পন্ন কোন কর্মচারীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব/চলতি দায়িত্ব প্রদান করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে।

এসব যুক্তি দেখিয়ে প্রস্তাবিত নিয়োগবিধি চূড়ান্তকরণে বিলম্ব এবং নিয়োগবিধি অনুযায়ী নিয়োগে বিলম্ব হওয়ায় সহকারী ইন্সট্রাক্টারের বিপুল সংখ্যক পদ শূন্য থাকার কারণে স্নাতকোত্তর ও বিএড ডিগ্রীধারী যোগ্যতাসম্পন্ন ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের সহকারী ইন্সট্রাক্টর চলতি দায়িত্ব দেওয়া যায়।

শিক্ষকরা যা বলছেন:

এই চিঠির আপত্তি জানানোর পাশাপাশি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রাথমিকের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, অধিদপ্তরের ওই চিঠি অনুযায়ী, ইউআরসিতে কর্মরত ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের ‘সহকারী ইন্সট্রাক্টর’ পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে তাদের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার যে চেষ্টা চালানো হচ্ছে তা রীতিমত শিক্ষকদের অপমান করা।

আরও পড়ুন>>প্রাথমিকের শিক্ষক মারা গেলে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ দেবে ট্রাস্ট

এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি বদরুল আলম মুকুল বলেন, এই সিদ্ধান্ত শিক্ষকদের জন্য লজ্জাজনক ও অপমানজনক। এমনিতেই প্রাথমিক শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে কোনো পদোন্নতি পাচ্ছেন না। অথচ ইউআরসির ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা ‘নন অ্যাকাডেমিক পদধারী’ হয়েও পদোন্নতি পাচ্ছেন না ও তারা ১৬তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে যাচ্ছেন। এ নিয়ে আমাদের মিটিং থেকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. শামসুউদ্দিন মাসুদ বলেন, একজন শিক্ষক ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের কাছে প্রশিক্ষণ নেবেন এটা মেনে নেওয়া যায় না। এমন হলে শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা থাকল না। আমরা চাই অধিদপ্তর এ সিদ্ধান্ত বাতিল করুক। এ নিয়ে আমরা অধিদপ্তরে একটি আবেদন জমা দিয়েছি। তারা এটি বিবেচনা না করলে আমরা আন্দোলনে যাব। এ নিয়ে সমিতির সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

আরও পড়ুন>>স্বচ্ছতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করা হবে : গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমাজের সভাপতি আনিসুর রহমান বলেন, আমরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেও ১০ম গ্রেডে যেতে পারছি না। অথচ ডাটা এন্ট্রি অপারেটটরা ১৬তম গ্রেড থেকে ১০ গ্রেডে কীভাবে আসেন। এটি মানা যাবে না; এসএসসি পাস শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে তারা কীভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষক হবেন— এমন প্রশ্নও তার।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ধরনের একটি চিঠি মহাপরিচালক আমাকে পাঠিয়েছেন বলে শিক্ষকরা অমাকে জানিয়েছেন। যদিও বিষয়টি আমার নজরে আসেনি। আমি খোঁজ-খবর নিচ্ছি। চিঠিটি দেখার পর মন্তব্য করতে পারব।

এ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

এনএম/কেএ