জাল সনদ ধরতে মাঠে ডিপিই
• শিক্ষকদের সনদ সংগ্রহে মাঠে কর্মকর্তারা
• নিরাপত্তাহীনতায় তথ্য সংগ্রহকারীরা
দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাডেমিক ও পেশাভিত্তিক সনদ যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। শিক্ষকদের অনেকে জাল সনদে চাকরি করছেন এবং উচ্চতর গ্রেড নিয়েছেন— এমন অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পর মাঠে নেমেছে অধিদপ্তর।
ডিপিই সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষকদের সনদ দুই ধাপে যাচাই হবে। প্রথম ধাপে ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয়করণ হওয়া শিক্ষকদের একাডেমিক ও ‘ব্যাচেলর অব এডুকেশন’ (বিএড) কোর্স, দ্বিতীয় ধাপে একাডেমিকসহ অন্যান্য সনদ যাচাই করা হবে। একাডেমিক ও পেশাভিত্তিক সনদ যাচাইয়ে উভয়ক্ষেত্রে বেসরকারি ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদগুলো আগে বিবেচনায় আনা হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে দারুল ইহসান, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি ও রয়েল ইউনিভার্সিটির সনদগুলো আগে যাচাই করা হবে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন >> জাল সনদে ৮ বছর চাকরি, শিক্ষিকার বিরুদ্ধে চার্জশিট
তবে, সারাদেশের ৬৫ হাজারের বেশি বিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে চার লাখ শিক্ষকের এত সনদ কোন পদ্ধতিতে যাচাই করা হবে তা এখনও ঠিক করতে পারেনি অধিদপ্তর।
জানতে চাইলে ডিপিই প্রশাসন শাখার উপপরিচালক (তদন্ত ও শৃঙ্খলা) ড. নাছিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বেশকিছু শিক্ষকের বিএড ও একাডেমিক সনদ জাল প্রমাণ হওয়ার পর সারাদেশের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সনদ যাচাইয়ের জন্য চিঠি দিয়েছি। প্রথম ধাপে বিএড বা সমতুল্য সনদগুলো সংগ্রহ করে তা অধিদপ্তরে পাঠাতে বলা হয়েছে।’
এর মধ্যে কোন সনদ জাল, তা কীভাবে চিহ্নিত করবেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়ে এর সত্যতা যাচাই করা হবে।’
আরও পড়ুন >> জালিয়াতি : ৪৭৭ জন প্রাইমারি শিক্ষকের নিয়োগ স্থগিত
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কাজটি করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। এ দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, জাল সনদ চিহ্নিত করা খুবই জটিল কাজ। কারণ, যে প্রতিষ্ঠান তার সনদ ইস্যু করেছে তারা কখনোই জাল বলবে না। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ আরও কিছু সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে তা চিহ্নিত করতে হয়। এ সক্ষমতা ডিপিই’র আছে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তারপরও এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এ কারণে তাদের সাধুবাদ জানাই।
শিক্ষকদের সনদ দুই ধাপে যাচাই হবে। প্রথম ধাপে ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয়করণ হওয়া শিক্ষকদের একাডেমিক ও ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) কোর্স, দ্বিতীয় ধাপে একাডেমিকসহ অন্যান্য সনদ যাচাই করা হবে
ডিআইএ’র এক পরিদর্শক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সময় সব শিক্ষকের সনদ সংগ্রহ করে আনা হয়। প্রাথমিক যাচাইয়ের পর কারও সনদ সন্দেহ হলে তা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ইউজিসি ও সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। দুই জায়গা থেকে যাচাই হলে প্রকৃত তথ্যটি পাওয়া যায়। একপক্ষীয় যাচাইয়ে কখনও প্রকৃত তথ্য আসে না বলেও জানান তিনি।
যেভাবে সংগ্রহ করা হবে সনদ
গত ২২ মার্চ ডিপিই উপপরিচালক ড. নাছিমা বেগম সারাদেশের জেলা শিক্ষা অফিসারদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করেন, ২০১৩ সাল এবং এরপর বিভিন্ন ধাপে জাতীয়করণ হওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড/সিএড, সিইনএড সনদ নিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ জাল সনদ গ্রহণ করেছেন। এ সনদ দিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্কেলের বেতন-ভাতাদি গ্রহণ করছেন। এতে সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আরও জানা যায় যে দেশব্যাপী এ জাল সনদ প্রদানে বিভিন্ন সিন্ডিকেট রয়েছে।
এক্ষেত্রে সারাদেশের জাতীয়করণ করা শিক্ষকদের সনদ যাচাইয়ে আপনার আওতাধীন সব উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে জাতীয়করণ করা শিক্ষকদের সনদের সত্যায়িত কপি আগামী ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ডিপিই উপপরিচালক, তদন্ত ও শৃঙ্খলা শাখায় পাঠাতে অনুরোধ করা গেল। শিক্ষকদের বিএড, সিইনএড সনদের সত্যায়িত কপি, সেই সঙ্গে স্কুলের নাম, জাতীয়করণের তারিখ, বিএড, সিএড, সিইনএড সনদ দেওয়া প্রতিষ্ঠানের নাম, ভর্তির তারিখ, পাসের বছর, গ্রেড ও সনদের যথার্থতা সম্পর্কে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামতসহ পাঠাতে বলা হয়েছে।
সনদ যাচাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ঢাকা পোস্টকে ড. নাছিমা বেগম বলেন, যেসব শিক্ষক উন্মুক্ত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ নিয়েছেন, তাদের সনদগুলো আগে যাচাই করা হবে।
এক্ষেত্রে শুধু বিএড/সিএড, সিইনএড নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেওয়া অনার্স/মাস্টার্সের সনদ যাচাই করা হবে। ধীরে ধীরে সবার সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর। অর্থাৎ কেউ যাচাইয়ের বাইরে থাকবেন না। কাজটি আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও এখন থেকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে।
শুধু সরকারি নয়, পর্যায়ক্রমে রাজস্ব খাতে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের সনদও যাচাই করা হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জাল শিক্ষকদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনেক সময় লেগে যায়।
জানা গেছে, প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে পুরুষদের স্নাতক বা সমপর্যায়ের ডিগ্রির বিধান দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ২০১৮ সাল থেকে নারী প্রার্থীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক করা হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্তসহ বিতর্কিত কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়ে। কিছু শিক্ষকের সনদের ব্যাপারে সন্দেহ হওয়ায় সম্প্রতি কয়েকটি সনদ যাচাই করা হয়। এর মধ্যে কয়েকটির জাল ধরা পড়ে।
এদিকে, সনদের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জের এক উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ হয় স্থানীয়ভাবে। শিক্ষকরা সবাই স্থানীয় এবং কেউ কেউ বেশ প্রভাবশালী। তাদের সনদ সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা ধরনের ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। কিছুক্ষেত্রে হুমকিরও সম্মুখীন হতে হয়। জাল শিক্ষক শনাক্তের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর তারা জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
আরও পড়ুন >> ভুয়া সনদে ৮ বছর ধরে প্রধান শিক্ষক তিনি
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, শুধু সরকারি নয়, পর্যায়ক্রমে রাজস্ব খাতে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের সনদও যাচাই করা হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জাল শিক্ষকদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনেক সময় লেগে যায়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কয়েকজন শিক্ষকের জাল সনদ শনাক্ত করা হয়। কিন্তু আজ অবধি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এ প্রক্রিয়া অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। আবার সনদগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে একটি ফি দিয়ে যাচাই করা হয়। সেজন্য সময়ও লাগে।
প্রমাণ মিললে যেসব শাস্তি
কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে জাল সনদে চাকরি বা উচ্চতর গ্রেড নেওয়ার প্রমাণ মিললে দুই ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। চাকরিতে প্রবেশের যোগ্যতা হিসেবে যেসব সনদ প্রয়োজন হয় যেমন- স্নাতক সনদ, এগুলো জাল প্রমাণিত হলে তাকে চাকরিচ্যুত করার বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার পর বিভাগীয় মামলা হবে। এসব প্রক্রিয়া শেষ করতে দীর্ঘসময় লেগে যায়।
অন্যদিকে, চাকরিতে উচ্চতর গ্রেডে যাওয়ার জন্য বিএড বা সমজাতীয় সনদের প্রয়োজন হয়। এসব সনদ জাল প্রমাণিত হলে দুই ধরনের শাস্তি দিতে পারে প্রশাসন। প্রথমত, সনদের বিপরীতে যে পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেছেন তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, তাকে চাকরিচ্যুত করা। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ ফেরত নেওয়ার শাস্তিটি বেশি প্রয়োগ করা হয় বলে প্রশাসন শাখার কর্মকর্তারা বলছেন।
এনএম/এমএআর