উপাচার্য না থাকার পরও ইউডার সমাবর্তন নাটক, ক্ষুব্ধ নিবন্ধনকারীরা
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ-এর (ইউডা) সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গত ২৭ জুলাই। সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পরও একদিন আগে ওই সমাবর্তন স্থগিত করা হয়। এতে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে সমাবর্তনে নিবন্ধন করা গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে। কেন স্থগিত করা হলো- এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে আছে ইউজিসি ও ইউডা।
ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ-এর সবশেষ সমাবর্তন হয়েছিল ২০১৮ সালে। এরপর ২০২০ সালে সমাবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় নিবন্ধন ফি। সব প্রস্তুতি নেওয়া হলেও করোনার কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। ওই সমাবর্তনেরই নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল গত ২৭ জুলাই (বুধবার)।
বিজ্ঞাপন
সমাবর্তনে অংশ নিতে নির্ধারিত ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশনসহ সব কাজ শেষ করে ক্যাম্পাস থেকে গাউনও সংগ্রহ করেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীরা। হঠাৎ করে আগের দিন বিকেলে তারা জানতে পারেন 'অনিবার্য কারণে' সমাবর্তন স্থগিত। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষার্থীরা এসেছিলেন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এখানে এসে দেখেন অনুষ্ঠান হবে না। এমনকি যারা স্থগিত হওয়ার খবর জানতে পারেননি তারা কেউ কেউ সমাবর্তন হওয়ার দিন অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিতও হয়েছিলেন।
কেন স্থগিত হলো সমাবর্তন?
জানা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই ২০২১ সাল থেকে। এরপরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের সমাবর্তন আয়োজনের তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছে। আবার সমাবর্তনের সময় অবশ্যই থাকতে হবে এমন পদ (উপাচার্য) শূন্য থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত না করে সমাবর্তন আয়োজনে নেমে পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে অনুমোদন আসে ২০২০ সালে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ সবাই ছিলেন। রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে এই সমাবর্তন আয়োজনের কথা। কিন্তু করোনার কারণে সমাবর্তন আয়োজন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি।
করোনার সংক্রমণ কমে যাওয়ায় এ বছর ফের সমাবর্তনের প্রস্তুতি নেয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। ঈদের আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় '২৭ জুলাই'। সে আলোকে তারা প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু যখন জানা গেল, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ কেউই নেই, তখন সমাবর্তন স্থগিত করেন শিক্ষামন্ত্রী। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি একদিন আগে জানানো হয়।
ইউডার ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর স্বামীর করোনা হওয়ায় তিনি সমাবর্তনে আসতে পারবেন না জানিয়েছেন। সেজন্য সমাবর্তন স্থগিত করা হয়েছে।
‘উপাচার্য না থাকার কারণে সমাবর্তন স্থগিত করা হয়েছে’ বলে জানা যাচ্ছে- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইউজিসি বলেছিল মিটিং করে জুন মাসের মধ্যে পুরো সেটআপ অনুমোদন করে দেবে। সমাবর্তনের আগেই এটা দেওয়ার কথা ছিল। আমরা অফিশিয়াল চিঠিও পেয়েছি সমাবর্তন শুরু করার। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই সবকিছু জেনেই সমাবর্তনের ম্যাগাজিনের জন্য বাণী দিয়েছেন। না জানলে তো আর আমরা এটা আনতে পারি না!
আরও পড়ুন: ‘র্যাগ ডে’ উদযাপনের নামে অশোভন আচরণ বন্ধের নির্দেশ ইউজিসির
তিনি বলেন, আমাদের উপাচার্য এমাজউদ্দিন স্যার মারা গেলেন, এরপর রফিকুল ইসলাম শরীফ স্যার আসলেন। কিছুদিন পর তিনি স্ট্রোক করলেন। আমরা তার জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করলাম। এরপর অধ্যাপক রহমতউল্লাহকে উপাচার্য, আহমদুল্লাহ মিয়াকে উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষের জায়গায় আরেকজনের নাম দিয়ে পাঠানো হয়। এই নামগুলোতে তারা (ইউজিসি) `ওকে` বলেছেন। যদিও অফিশিয়াল চিঠি আমরা পাইনি।
এই নামগুলো কি কেবল সমাবর্তনের জন্যই দেওয়া হয়েছিল- জানতে চাইলে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, এভাবে এক-একজনের নাম পাঠানোর অর্থ তো তাই দাঁড়াচ্ছে। এভাবে নাম বসিয়ে ইউজিসিতে পাঠাতে পারে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই উত্তর আমার কাছ থেকে না নিলে ভালো হয়।
সমাবর্তনের নামে টাকা ওঠানোই ছিল লক্ষ্য?
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থী সমাবর্তনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছে। ফি হিসেবে অনার্সের জন্য ৬ হাজার এবং মাস্টার্সের জন্য ৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে তাদের। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শুধুমাত্র টাকা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এত তড়িঘড়ি করেছে।
তাড়াহুড়ো করে ছবি নিলেও কনভোকেশন বুকে অনেকের ছবি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন নিবন্ধনকারীরা। যাদের ছবি এসেছে, তাদের অনেকের ক্ষেত্রে ছবি ও নামের গরমিল দেখা গেছে। এছাড়া কমিউনিকেশন্স এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের নাম বইয়ে লেখা হয়েছে `কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম`!
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের মাঝে। শারমিন আক্তার সুইটি নামে সমাবর্তনে নিবন্ধনকারী একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদের চারদিন পরে আমার পিত্তথলীর পাথরের অপারেশন হয়েছিল। সমাবর্তন তো মানুষের জীবনে একবারই আসে, তাই স্বামীকে রাজি করিয়েছি। কুষ্টিয়া থেকে ৮ ঘণ্টা জার্নি করে ঢাকায় পৌঁছে শুনি, সমাবর্তন স্থগিত হয়েছে। তখন মাথায় কিছুই কাজ করছিল না।
আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে নৈতিক শিক্ষা যুক্ত করার আহ্বান ইউজিসির
তিনি বলেন, আমার পরিচিত অনেকের অভিভাবক বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় গিয়েছে। হাজার কষ্ট ভুলে আনন্দ নিয়ে সবাই গিয়েছিল, কিন্তু তাদের আনন্দ মাটি করে দিল প্রশাসন। আমি তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার জন্য কল দিয়েছি। আমি যদি অসুস্থ না হতাম, চাকরি না করতাম, তাহলে এর জবাব নিয়েই ঘরে ফিরতাম।
ইউডার শিক্ষার্থী নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি অফিসের বসের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সমাবর্তনের টাকা দিয়েছি। রেজিস্ট্রার জানতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ নেই, তারপরও শুধুমাত্র টাকা নেওয়ার জন্য তারা এমন কাজ করেছেন। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন, তারা খুবই গাফিলতির পরিচয় দিয়েছেন। সবকিছু জেনেও তারা যে কাজটি করেছেন, এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কোনোভাবেই তারা এর দায় এড়াতে পারে না।
তিনি বলেন, কেন সমাবর্তন স্থগিত হলো, তার সঠিক জবাব তারা এখন পর্যন্ত দেয়নি। আমি একজন শিক্ষার্থী হিসেবে খুব দ্রুতই সরাসরি উপস্থিত হয়ে তাদের কাছে এর জবাব চাইব। এমন করলে নতুন শিক্ষার্থী কী দেখে ভর্তি হবে? বিষয়টি আমাদের নিজেদের জীবনেও প্রভাব ফেলবে।
কমিউনিকেশন্স এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফারজানা স্মৃতি বলেন, পুরো নাটকীয়ভাবে সমাবর্তন স্থগিত করা হয়েছে। আমাদেরকে বলা হয়েছিল শিক্ষামন্ত্রী অসুস্থ। সে কারণে সমাবর্তন স্থগিত। কিন্তু পরে জানতে পারলাম, বাস্তবতা বিপরীত। কয়েকটি পদ খালি থাকায় এটি স্থগিত হয়েছে। প্রশাসন তো এবারই প্রথম সমাবর্তন দিচ্ছে না, এর আগেও কয়েকবার দিয়েছে। তাদের তো জানার কথা এসব পদ না থাকলে আমরা সমাবর্তন দিতে পারব না। তাহলে তারা শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের এমন দুর্দশায় ফেলল কেন?
ফারজানা বলেন, আমি চাকরি থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে সমাবর্তনই হলো না। এটা আমার প্রতিষ্ঠান, আমার জন্যও এটা লজ্জাজনক। আমি অবশ্যই এর একটা জবাবদিহিতা চাই।
ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যা বলছে
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দেন রাষ্ট্রপতি। তিনি যেতে না পারলে তার প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী সনদ দেন। সনদে মূল সাক্ষর করতে হয় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত উপাচার্যকে। এর বিকল্প কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন হবে কিন্তু উপাচার্য নেই, তাহলে সনদে সাক্ষর করবে কে? এটা তো অবৈধ।
তিনি বলেন, তাদের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ নেই। এখনও তারা নিজস্ব ক্যাম্পাসে যায়নি। আসলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তারা যখন সমাবর্তনের জন্য তারিখ চায়, তখন তো আর সরকার এই বিষয়ে জানতে না। সমাবর্তনের আগে সবসময়ই ইউজিসিকে চিঠি দিয়ে তাদের সব ক্রাইটেরিয়া পূরণ হয়েছে কি না জানতে চায় সরকার। ইউজিসি থেকেও বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন শিক্ষার্থীদের দায়-দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়কেই নিতে হবে। শিক্ষার্থীরাও একদিক দিয়ে বেঁচে গেছে, এই সনদ পেলে তাদের সাথে প্রতারণা করা হতো।
ড. ফেরদৌস জামান বলেন, শিক্ষার্থীদের সাথে অন্যায় করা হয়েছে। আমিও বিশ্বাস করি, টাকা তোলার জন্যই তারা এমনটি করেছে। হয়তো তারা জানত যে, সমাবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এটা পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণার শামিল।
সমাবর্তন আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ-এর ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি মুনির আহমেদ বলেন, আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মান-মর্যাদা এবং আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কী কারণে সমাবর্তন হয়নি এটা বলে এখন কারো বিরাগভাজন হতে পারব না। দায় যে আসলে কার, এটা এই মুহূর্তে বলতে পারব না। এই বিষয়ে রেজিস্ট্রার ভালো বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. ইফফাত কায়েস চৌধুরীকে বারবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এএজে/জেএস