মাস যায়, বছর যায়, নাম-তারিখ আর সংশোধন হয় না
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. হেলাল মুন্সি। ২০২১ সালের শুরুতে জেএসসি ও এসএসসি সার্টিফিকেটে মায়ের নাম সংশোধনের জন্য আবেদন করেন বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে। মাস তিনেকের মধ্যে তিনি সার্টিফিকেটের সংশোধিত কপি পেয়ে যান।তবে এইচএসসির সনদে মায়ের নাম সংশোধন করতে গিয়ে নানা জটিলতায় আটকে যান তিনি। এক বছরেও ওই সংশোধনীটি করতে পারেননি হেলাল।
গত বছরের ২৭ মে তিনি এইচএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেটে মায়ের নাম সংশোধনের জন্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে আবেদন করেন। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তার মায়ের নাম সংশোধনে সভা ডাকেনি বোর্ড। মায়ের নামে বড় ধরনের সংশোধন করতে হবে, তাই দেরি হচ্ছে বলে বোর্ড থেকে তাকে জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলোতে পরীক্ষার সনদে নাম পরিবর্তন করতে গিয়ে এভাবে মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে প্রার্থীদের। বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, নামের ছোটোখাটো সংশোধনের ক্ষেত্রে দ্রুত কাজ হয়ে যাচ্ছে। তবে বড় ধরনের পরিবর্তনে বা জন্মতারিখের সমস্যার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগছে।
জানা যায়, নামের সামান্য ভুলের ক্ষেত্রে মিটিং কল না করে দ্রুত সমাধান দেয় শিক্ষা বোর্ডগুলো। তবে, বড় কোনো পরিবর্তন, সংযোজন-বিয়োজনের জন্য বোর্ডসভা ডাকা হয়। আবেদনকারীর মোবাইল নম্বরে এসএমএস-এর মাধ্যমে মিটিংয়ের তারিখ ও সময় জানানো হয়।
এরপর সব সনদপত্রের মূল কপি, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম সনদ, এফিডেভিট, প্রাথমিক সমাপনী সনদ, সিটি/পৌর মেয়র/ কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র, বয়স সংশোধনের ক্ষেত্রে সিভিল সার্জন কর্তৃক বয়স প্রমাণের সনদ, আবেদনকারীর অভিভাবকসহ মিটিংয়ে হাজির হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এসব কাগজ প্রদর্শন করেও ফল পেতে মাসের পর মাস সময় গুনতে হচ্ছে আবেদনকারীদের।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার চাঁদপুর দাখিল মাসরাসায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন শাহাদাত হোসেন। এরপর তানোর পৌরসভা টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজ থেকে এসএসসি ভোকেশনাল শেষ করে লালপুর মডেল কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন। ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট তিনি নিজের নামের পাশাপাশি বাবা ও মায়ের নাম সংশোধনের জন্য আবেদন করেন। এরপর তাকে বোর্ড থেকে জানানো হয়, তার মায়ের নাম সংশোধন করা যাবে না। পুনর্বিবেচনার জন্য যেন আবার আবেদন করা হয়। এরপর ওই বছরের ১৬ নভেম্বর তিনি মায়ের নাম সংশোধনে পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে তাকে সভায় ডাকা হয়। সেখানে ইবতেদায়ী সার্টিফিকেটে ভুল দেখে বোর্ড পুনরায় তাকে আবেদন করতে বলে।
শাহাদাত বলেন, ইবতেদায়ী সার্টিফিকেটে সংশোধনের কাজটি ডিজিটাল নয়, যে কারণে আমাকে সশরীরে সবকিছু করতে হয়েছে। কাজের উদ্দেশ্যে আমি থাকি গাজীপুর। অন্য সময় রাজশাহীতে নিজ বাড়িতে থাকি। আমার পারিবারিক অবস্থা ভয়ানক। তারপরও দৌড়ঝাপ করে মার্চ মাসের ২৮ তারিখে আমি ইবতেদায়ী সার্টিফিকেটে সংশোধনের আবেদনও করি। বোর্ড থেকে বলা হয়েছে, এটা সংশোধনের পর আবার আমাকে টাকা জমা দিয়ে আগের মতো আবেদন করতে হবে। এটা যে আমার জন্য কতটা কঠিন হবে তা একমাত্র আমি জানি।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদুল্লাহ আল গালিব তার নিজের ও বাবার নাম সংশোধনের জন্য ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি যশোর বোর্ডে আবেদন করেন। ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর সভা আহ্বান করে তাকে ও তার অভিভাবককে ডাকা হয় বোর্ডে। চলতি বছরের মার্চে তার অনলাইন স্ট্যাটাস চেঞ্জ হয়। কিন্তু এরপর আবার চিঠি ইস্যু করায় জটিলতা দেখা দেয়। সবশেষ গত রোববার তিনি সংশোধিত কপি হাতে পান।
তিনি বলেন, যারা বোর্ডে যাচ্ছে, তাদের কাজ আগে হচ্ছে। যারা যাচ্ছে না, তাদেরটা দ্রুত হচ্ছে না। আবার এক রুম থেকে অন্য রুম ঘোরার ভোগান্তি তো আছেই। সবকিছু এমন অ্যানালগই চলছে। মুখে মুখে কেবল ডিজিটাল!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী শম্পা দাস। জেএসসি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব সার্টিফিকেটে তার নিজের নামের পাশাপাশি বাবা ও মায়ের নামের বানানে ভুল হয়েছে। নাম সংশোধন চেয়ে মাস দুয়েক আগে তিনি অনলাইনে আবেদন করেছেন। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড থেকে এখন পর্যন্ত তাকে কিছুই জানানো হয়নি। বিষয়টি নিয়ে হতাশায় দিন কাটছে শম্পার।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, জেএসসি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত সব সার্টিফিকেটেই আমার নিজের নাম, বাবার নাম ও মায়ের নামের বানানে অসঙ্গতি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটেও তাই। এসব সমাধান না করে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট সংশোধন করতে পারব না। নাম সংশোধনে শুনেছি বছরেরও বেশি সময় লাগে। এমনটা হলে তো অনেক বড় বিপদে পড়ব। চাকরির আবেদন করতে গেলে সমস্যায় পড়ব। দ্রুত নাম সংশোধনের ব্যবস্থা হলে আমি খুবই উপকৃত হতাম।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মাসরাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, আমি আজ সংশোধনের আবেদন করলাম আর কাল পেয়ে গেলাম, বিষয়টি এমন নয়। নামে স্পেলিং মিসটেক হলে আমরা খুব দ্রুতই সংশোধন করে দিই। সেক্ষেত্রে সভা ডাকতে হয় না। তবে বড় ধরনের সংশোধন যেমন এক নাম থেকে অন্য নামে পরিবর্তন বা জন্ম তারিখ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আবেদনের পর তাকে সভায় ডাকা হয়। সে সভায় সিভিল সার্জন, ডাক্তার, আইনজ্ঞ, শিক্ষক, অভিভাবক থাকেন। যাচাই-বাছাই করে তার নাম ও জন্মতারিখ সংশোধন করা হয়। আবেদন সঠিক না হলে সংশোধন না হওয়ার বিষয়েও বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়। এ এখতিয়ার বোর্ডের আছে। আমি চাইলাম আর সাথে সাথে নাম ও তারিখ পরিবর্তন হয়ে গেল, বিষয়টি এত সহজ নয়। এখানে আইনি বিষয়ও জড়িত। কোনো কিছু ব্যত্যয় হলে শেষে বোর্ডকেই সবাই দোষারোপ করবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকার কলেজ পরিদর্শক ও সংশোধন কমিটির অন্যতম সদস্য আবু তালেব মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, শিক্ষা বোর্ডের সবকিছুই এখন প্রায় ডিজিটাল হয়ে গেছে। আগে নাম বা জন্ম তারিখ সংশোধনের আবেদন, স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রত্যয়নপত্র থেকে শুরু করে সবকিছুই সশরীরে করতে হতো। এখন সবকিছু ডিজিটালি করা যাচ্ছে। ৬ দিনের কাজ ৬ মিনিটে হয়ে যাচ্ছে। সামান্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেখা যায় ৫/৬ দিন বা এক সপ্তাহেও সংশোধন হয়ে যায়। তবে, বড় নামের পরিবর্তন বা এক নাম থেকে অন্য নামে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বৈঠক ডাকা হয়। এটার জন্য প্রার্থীর মুঠোফোনে এসএমএস চলে যায়। এটা তো অনলাইনে সম্ভব নয়। কারণ, আপনার নাম পরিবর্তনের আবেদন যে সঠিক সেটা আমরা কীভাবে নিশ্চিত হব! বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থা তো এখনও অনলাইনভিত্তিক হয়নি।
তিনি বলেন, সংশোধনের আবেদনের প্রেক্ষিতে বোর্ডের চেয়ারম্যান ২০-২২ জনের একটি কমিটি গঠন করেন। এসব কমিটিতে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ কলেজের অধ্যক্ষ, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের একজন সদস্য, ঢাকার সিভিল সার্জন, একজন আইনজ্ঞ এবং বোর্ডের ৮ ডেপুটি থাকেন। কখনো কখনো কমিটিতে অন্য কাউকেও রাখা হয়। এটা বোর্ডের চেয়ারম্যানের এখতিয়ার। কখনো প্রার্থী বেশি হলে আলাদা দুটি কমিটি করে তাদের মাঝে আবেদনগুলো ভাগ করে দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, নাম সংশোধনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। সিরিয়াল অনুযায়ী যাচাই করা হয়। সেক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ থাকার কথা নয়। তারপরও কারো অভিযোগ থাকলে বুঝতে হবে তার আবেদনের সময় কোনো কাগজ মিসিং ছিল। বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সময় দিতে হয়।
এএজে/জেএস