আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষকে অবাঞ্ছিত করলেন শিক্ষকরা
ভুয়া পিএইচডি, আর্থিক দুর্নীতিসহ ও ব্যাপক অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে রাজধানীর ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ মো. জসিম উদ্দীন আহম্মেদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন ওই কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
শুক্রবার (৩ জুন) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সংবাদ সম্মেলন থেকে অধ্যক্ষকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। গভর্নিং বডি তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে শনিবার (৪ জুন) থেকে একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষকরা।
বিজ্ঞাপন
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান আইডিয়াল কলেজের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোবাশ্বের হোসেন। এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন- ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সেগুপ্তা ইসলাম, অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুরেশ চন্দ্র জয়ধর, আইসিটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মারুফ নেওয়াজ, বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মিয়ারুল ইসলাম রাজন প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনে কলেজের শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদ ২০১৭ সালের মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ পান। যোগ দেওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনৈতিক কার্যক্রম, অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা শুরু হয়।
মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক তৌফিক আজিজ চৌধুরী, বাংলা বিভাগের শিক্ষক তরুণ কুমার গাঙ্গুলী, গণিত বিভাগের শিক্ষক মো. মনিরুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে অধ্যক্ষ রাজধানীর সুপ্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের মতো পরিচালনা করেছেন।
এ শিক্ষকেরা অধিকাংশ সময় শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে বিরত থেকে অধ্যক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন অবৈধ/অনৈতিক কাজ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ও তা সম্পাদন করে থাকেন। তারা বিভিন্ন সময়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ডেকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা, ভর্ৎসনা করা, কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া, চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া ইত্যাদি হুমকি দিয়ে প্রতিষ্ঠানে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকরা বলেন, অধ্যক্ষ কলেজে যোগ দেওয়ার প্রথম বছরেই তার অনৈতিক কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ এনে চারজন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করেন, একাধিক কর্মচারীকে চাপ প্রয়োগে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। আরও অনেক শিক্ষক-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুতির হুমকি দিয়েছেন। অধ্যক্ষ সম্পর্কে যতটা জানা যায়, পূর্বে তিনি যেসব কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, প্রতিটিতেই দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের কারণে তিনি অভিযুক্ত ও তিরস্কৃত হয়েছেন।
অধ্যক্ষ, শিক্ষক তৌফিক আজিজ চৌধুরী, তরুণ কুমার গাঙ্গুলী অনলাইনে বা কোনো জালিয়াতির মাধ্যমে মালিবাগ মোড়ে অবস্থিত ‘লিনকলন্স’- হায়ার এডুকেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (শাহজালাল টাওয়ার ৬ তলা, ৮০/এ/১, সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোড) নামে প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ডক্টরেট ডিগ্রির সার্টিফিকেট কিনে তা কলেজে জমা দিয়ে পদোন্নতি ও বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, অধ্যক্ষের সব অপকর্মের সহযোগী শিক্ষক তৌফিক আজিজ চৌধুরী ২০১৩ সালে সাচিবিক বিদ্যা বিষয়ের প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পান। নিয়োগের সময় না দেখালেও পরবর্তীতে তিনি ‘উলানিয়া মোজাফফর খান ডিগ্রি কলেজ, মেহেন্দিগঞ্জ’ থেকে ১৪ বছর ৪ মাস অভিজ্ঞতা দেখিয়েছেন। পরে জানা যায়, একই সময়ে আলৌকিকভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ও উলানিয়া মোজাফফর খান ডিগ্রি কলেজ, মেহেন্দিগঞ্জে তিনি চাকরি করেছেন। গভর্নিং বডির কতিপয় সদস্যের যোগসাজশে চাকরির পূর্ব অভিজ্ঞতা ও অত্র প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে প্রথমে সহকারী অধ্যাপক ও আবার তিন বছরের ব্যবধানে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পেয়েছেন। তিনি বর্তমান অধ্যক্ষের যোগদানের পর থেকে অবৈধ পন্থায় গভর্নিং বডির ‘শিক্ষক প্রতিনিধি সদস্য’ হিসাবে যোগ দিয়ে সকল রকমের দুর্নীতি ও অনিয়মগুলো আড়াল করায় সহযোগিতা করেছেন।
অধ্যক্ষের সব অপকর্মের আরেক সহযোগী শিক্ষক তরুণ কুমার গাঙ্গুলী পূর্ববর্তী কলেজের ভুয়া অভিজ্ঞতার কাগজপত্র দেখিয়ে, অল্প সময়ের ব্যবধানে কলেজের পদোন্নতি নীতিমালায় সুবিধাজনক পরিবর্তন এনে তৌফিক আজিজ চৌধুরীর মতো সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে মোট দুবার পদোন্নতি পেয়েছেন। তার কলেজ থেকে প্রাপ্ত আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও অবৈধভাবে প্রাপ্ত অর্থ, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসরত তার পরিবারের কাছে অবৈধ পথে নিয়মিত পাচার করেছেন। সেখানে তিনি প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনিও বর্তমান অধ্যক্ষের যোগদানের পর থেকে অবৈধ পন্থায় গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি সদস্য হিসাবে যোগ দিয়ে অধ্যক্ষ ও তাদের নিজেদের সব দুর্নীতি ও অনিয়ম আড়াল করায় সহযোগিতা করেছেন। অধ্যক্ষের অপকর্মের সব সহায়তাকারী বিভিন্ন রকমের দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছেন এবং অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
শিক্ষকরা বলেন, শিক্ষার্থীদের লেনদেনের জন্য প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকলেও ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহারে অধ্যক্ষ ও তার সহযোগীদের মধ্যে বেশ অনীহা দেখা যায়। ইদানিং শিক্ষার্থীদের থেকে প্রতিষ্ঠানের পাওনা অধ্যক্ষ সাহেবের মালিকানাধীন ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আদায় করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০২২ সালে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির সময় ডাচ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে প্রায় দু কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করা হয়।
অধ্যক্ষ ও তার অপকর্মের সহায়তাকারীদের বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম এবং প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুটপাট ও আত্মসাতের প্রধান খাতগুলো তুলে ধরেন শিক্ষকরা। সেগুলো হলো-
১) নতুন ভর্তির সময় ইউনিফর্ম বাণিজ্য,
২) এইচএসসি পরীক্ষার মডেল টেস্ট,
৩) বোর্ড ব্যবহারিক পরীক্ষা,
৪) উন্নয়নের নামে কলেজের স্থায়ী ফান্ড তছরুপ,
৫) কলেজ হোস্টেলের টাকা আত্মসাৎ,
৬) শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম ও নিয়োগ বাণিজ্য,
৭) অভ্যন্তরীণ ও বাইরের পরীক্ষায় খরচ,
৮) রিটেক পরীক্ষা, জরিমানা, পুনঃভর্তি ইত্যাদি।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকরা বলেন, একাদশ শ্রেণির নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তির সময় বাধ্যতামূলকভাবে বিনা রশিদে নগদ টাকার বিনিময়ে কলেজের ‘ইউনিফরমের কাপড় ও জুতা’ প্রদান করা হয়। নিম্নমানের কাপড় ও জুতার কারণে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে এসবের বিষয়ে প্রায়ই অভিযোগ করে। এ খাত থেকে বছরে প্রায় ৫০-৬০ লাখ টাকা আয় হয়, যা অধ্যক্ষসহ তৌফিক আজিজ চৌধুরী, তরুণ কুমার গাঙ্গুলী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ভাগ-বাটোয়ারা করে আত্মসাৎ করেন। সাধারণ শিক্ষকদের সারাবছর শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাছ থেকে অভিযোগ- ভর্ৎসনা শুনে সহ্য করতে হয়।
প্রত্যেক বছর বোর্ডের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র দেওয়ার সময় শিক্ষার্থীপ্রতি ২০০ টাকা করে অনৈতিকভাবে কোনো রশিদ ছাড়া আদায় করা হয়। বোর্ডের উচ্চ মাধ্যমিক ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় নিজ কলেজ ও বহিরাগত কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভালো নম্বর পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে শিক্ষার্থীপ্রতি যথাক্রমে ২ হাজার ৩শ টাকা ও ১ হাজার ৬শ টাকা করে অধ্যক্ষের সুনজরে থাকা অফিস সহকারীদের দিয়ে প্রতি কক্ষ থেকে অনৈতিকভাবে অর্থ আদায় করা হয়।
শিক্ষকরা আরও বলেন, অনৈতিকভাবে পরীক্ষার্থীদের নিকট থেকে টাকা আদায়ে সহায়তা করায় অস্বীকৃতি জানানোর কারণে রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোবাশ্বের হোসেন ও জীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. বজলুর রহমান সাইফুলকে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে অধ্যক্ষ সাহেব তার সুনজরে থাকা শিক্ষকদের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দিয়ে টাকা আদায় করেছেন।
আদায়কৃত সব টাকা বিশেষ খরচের নামে অধ্যক্ষসহ তৌফিক আজিজ চৌধুরী, তরুণ কুমার গাঙ্গুলী ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আত্মসাৎ করেন। ২০২১ সালের উচ্চ মাধ্যমিক ব্যবহারিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয় ও বোর্ডে জানাজানি হলে শিক্ষা বোর্ডের চাপের মুখে আদায়কৃত টাকা ফেরত দিতে হয়। এতে ঐতিহ্যবাহী কলেজটির সুনাম চরমভাবে নষ্ট হয়।
তরুণ কুমার গাঙ্গুলী, তৌফিক আজিজ চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কলেজের ফান্ড ব্যবহার করে নির্মাণ/সম্প্রসারণ করা হোস্টেলের ছাত্রদের কাছ থেকে আদায় করা সমস্ত অর্থ কলেজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমার বদলে আত্মসাৎ করা হয়। কলেজের হোস্টেলের আয়-ব্যয়ের কোনো স্বচ্ছ হিসাব-নিকাশ নেই। শিক্ষার্থীরাও সেখানে বিভিন্ন অভাব-অভিযোগে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করে থাকে।
বর্তমান সময়ে কলেজের অনুষ্ঠিত অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত পরীক্ষার ফি বাবদ জমা টাকার খরচের ক্ষেত্রে কোনো স্বচ্ছতা নেই। অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের জমা টাকা সম্পূর্ণ উত্তোলন করে প্রকৃত খরচের সঙ্গে বিভিন্ন ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে উত্তোলন করা টাকা খরচ হিসেবে দেখানো হয়। কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার টাকা সহজে আত্মসাৎ করার সুযোগ থাকায় শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে সিলেবাসের পড়া শেষ হওয়ার আগেই ঘন ঘন পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
শিক্ষকরা বলেন, প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্নকারী দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষসহ তার দোসর শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কলেজ গভর্নিং বডিকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছে। তবে কোনো এক অজানা কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আইডিয়াল কলেজের সাধারণ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গভর্নিং বডির সভাপতিকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। অন্য সদস্যদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক সভা করে দুর্নীতির বিশদ বিশ্লেষণও করা হয়েছে। এরপরও এ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার দৃশ্যমান প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
তারা বলেন, এমতাবস্থায় সব শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষ থেকে অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদ, শিক্ষক তৌফিক আজিজ চৌধুরী, শিক্ষক তরুণ কুমার গাঙ্গুলীকে আইডিয়াল কলেজে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হলো। গভর্নিং বডি তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত সব শিক্ষক-কর্মকর্তা কর্মচারী সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছে।
এএজে/আরএইচ