কারসাজি চক্রের ইশারায় উত্থান-পতন, দায় কার?
পুঁজিবাজারে একের পর এক কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হচ্ছে। যেসব কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হচ্ছে সেসব প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য হচ্ছে, শেয়ারের দাম বাড়ার তো কোনো কারণ নেই, নেই কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্যও। তারপরও বাড়ছে শেয়ারের দাম।
এমন অবস্থা হয়েছে যে এক টাকার শেয়ার দুই টাকা কিংবা তিন টাকা নয়, বেড়েছে ১৪ টাকারও বেশি। অর্থাৎ ১০০ টাকার শেয়ারের দাম বেড়ে হয়েছে ১৪০০ টাকা। তা-ও আবার তিন থেকে চার মাসের ব্যবধানে। যা স্বাভাবিকভাবে কোনো ব্যবসাতেই সম্ভব নয়।
বিজ্ঞাপন
পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্রেফ কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হচ্ছে। তারা বলছেন, সবপক্ষই মিলেমিশে টাকা লুটপাটের মহোৎসবে মেতেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আইনজীবী, অডিটর, প্রশাসন ক্যাডার— কেউ যেন বাদ যাচ্ছেন না। বিষয়টি দেখভালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব থাকলেও তারাও দায় নিচ্ছেন না!
স্রেফ কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হচ্ছে। সবপক্ষই মিলেমিশে টাকা লুটপাটের মহোৎসবে মেতেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আইনজীবী, অডিটর, প্রশাসন ক্যাডার— কেউ যেন বাদ যাচ্ছেন না। বিষয়টি দেখভালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব থাকলেও তারাও দায় নিচ্ছে না
গেল সপ্তাহে (১৭ থেকে ২১ অক্টোবর) দেশের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের মন্দাভাব পরিলক্ষিত হয়। ওই সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন হারিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। শুধু তা-ই নয়, কমেছে সবকটির মূল্যসূচক। এর পেছনেও কারসাজির গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। দায়িত্ব নেওয়ার পর করোনার কারণে বন্ধ থাকা পুঁজিবাজারের লেনদেন চালু করেন তিনি।
বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি সাধারণ বিমা করপোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। অর্থাৎ বিমা অঙ্গনের মানুষ ছিলেন তিনি। কারসাজি চক্রটি প্রথমে বিমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ম্যানিপুলেশন (কারসাজি) শুরু করে। পর্যায়ক্রমে তারা ওষুধ ও রসায়ন, প্রকৌশল, বস্ত্র এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের শেয়ারে কারসাজি করে।
কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়ানো প্রতিষ্ঠানের একটি হচ্ছে-জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড। কোম্পানির শেয়ারের দাম চলতি বছরের ১২ মে ছিল ৫৪ টাকা ৭০ পয়সা। সর্বশেষ ২১ অক্টোবর বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা ৯০ পয়সায়। অর্থাৎ পাঁচ মাসে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে ৮৫ টাকা করে। এর মধ্যে শেষ আড়াই মাস কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৪৯ টাকা।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২ আগস্ট শেয়ারটির দাম ছিল ৯১ টাকা ৮০ পয়সা। সেই শেয়ার ২১ অক্টোবর বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা ৯০ পয়সায়। ২০১৯ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বলে মনে করেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। এজন্য কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
নোটিশের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দাম বাড়ার পেছনে মূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে।
স্রেফ কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হচ্ছে। সবপক্ষই মিলেমিশে টাকা লুটপাটের মহোৎসবে মেতেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আইনজীবী, অডিটর, প্রশাসন ক্যাডার— কেউ যেন বাদ যাচ্ছেন না। বিষয়টি দেখভালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব থাকলেও তারাও দায় নিচ্ছে না
একইভাবে দাম বেড়েছে ফরচুন সুজ, সোনালী পেপার, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলসহ ১৮০ থেকে ২০০টি প্রতিষ্ঠানের। কারসাজির মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছে। ডিএসই ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে দায়সারা নোটিশ জারি করেছে। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি তাদের।
অন্যদিকে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গঠিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়ার বিষয়ে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখতে কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি।
শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে গঠিত অডিট কমিটি ব্যাংক খাতের কোম্পানি এনআরবি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির প্রমাণ পেলেও বিএসইসি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, জেনেক্স ইনফোসিসের মতো একইভাবে দাম বেড়েছে ফরচুন সুজ লিমিটেডের শেয়ারের। চলতি বছরের ১ জুন ফরচুনের শেয়ারের দাম ছিল ২১ টাকা ৬০ পয়সা। সেখান থেকে ৮৮ টাকা ৯৯ পয়সা বেড়ে গত ১৮ অক্টোবর তা দাঁড়ায় ১১০ টাকা ৫০ পয়সায়। অর্থাৎ দাম বেড়েছে সাড়ে চার গুণের বেশি।
গত বছর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানি সোনালী পেপারের শেয়ারের দাম ছিল (চলতি বছরের ২৭ জুন) ১৯৭ টাকা ৪০ পয়সা। সেখান থেকে ৩৮২ টাকা বেড়ে গত ১৮ অক্টোবর শেয়ারটি বিক্রি হয়েছে ৫৭৯ টাকা ৩০ পয়সায়।
জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড-এর শেয়ারের দাম চলতি বছরের ১২ মে ছিল ৫৪ টাকা ৭০ পয়সা। সর্বশেষ ২১ অক্টোবর বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা ৯০ পয়সায়। অর্থাৎ পাঁচ মাসে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে ৮৫ টাকা
বস্ত্র খাতের প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলের শেয়ার গত ২৩ মে ছিল ৪৩ টাকা ২০ পয়সা। সেখান থেকে ৪৮ টাকা বেড়ে গত ১১ অক্টোবর শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৯১ টাকা ২০ পয়সায়।
হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম এভাবে বাড়ার কারণ কী— জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানিতে কারসাজি হয়েছে কি না, তা দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমাদের চোখে ধরা পড়েছে এমন কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ার বিষয়টি দেখার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির প্রমাণ থাকার পরও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন ছিল সেটি। আমরা কোনো তদন্ত করিনি। তদন্ত করে কারসাজির প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কখনও মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে, কখনও ভালো লভ্যাংশ দেওয়া হবে— এমন গুজব ছড়িয়ে কারসাজি চক্র অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাজার। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিএসই-সিএসই এমনকি বিএসইসি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। ফলে পুঁজিবাজারে এখন উত্থান-পতন হচ্ছে কারসাজি চক্রের ইশারায়।
এনআরবি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজি
অভিযোগ আছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান এরআরবি ব্যাংক কারসাজি চক্রকে সুবিধা দিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ১০৩ কোটি টাকা লোকসান করেছে। ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা কাজটি করেছেন। এতে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমানতকারীদের অর্থও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ব্যাংকটির বিশেষ অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় (অডিট) এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছর বিমা খাতের প্রতিষ্ঠান প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স, জিবিবি পাওয়ার কোম্পানি ও এসকে ট্রিমস-এর শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানোর সহযোগিতা করে এনআরবি ব্যাংক। ব্যাংকটির কয়েকজন কর্মকর্তা তুলনামূলক বেশি দামে শেয়ার কিনে তা গড় বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে। মূলত কারসাজি চক্রকে মুনাফা করার সুযোগ দিতে এমন অনৈতিক কাজ করে এনআরবি ব্যাংকের অসাধু চক্রটি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ জানুয়ারি এনআরবি ব্যাংক প্রতিটি ১৪৪ টাকা ৩০ পয়সা মূল্যে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের এক লাখ শেয়ার কিনতে শুরু করে। এ দাম ছিল সেদিনের সর্বোচ্চ। আগের দিনের (১১ জানুয়ারি) তুলনায় তা ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। পরের দিন থেকে ওই শেয়ারের দাম কমতে শুরু করে এবং ১৭ জানুয়ারি প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ১২২ টাকা ৮০ পয়সায়। ওই সময় এনআরবি ব্যাংক কোনো শেয়ার কেনেনি।
অন্যদিকে, জানুয়ারির ২০ তারিখে যখন শেয়ারের দাম বাড়তে শুরু করে তখন এনআরবি ব্যাংক প্রতিটি ১৪৮ টাকা ৭৯ পয়সা মূল্যে এক লাখ শেয়ার কেনে। ১৭ জানুয়ারিতে থাকা দামের তুলনায় যা ছিল ২৭ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি। গত ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি গড়ে ১২০ টাকা ৭৫ পয়সা মূল্যে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের পাঁচ লাখ ৮৮ হাজার শেয়ার কেনে।
জিবিবি পাওয়ার কোম্পানি, এসকে ট্রিমস-এর মতো আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এনআরবি ব্যাংক একই পদ্ধতি অনুসরণ করে। এমন কারসাজির ঘটনায় ব্যাংকটিকে জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
বিমা কোম্পানিতে কারসাজি
গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিমা খাতের শেয়ারে কারসাজি হয়। করোনার মধ্যে যেখানে মানুষ বিমা করা কমিয়েছে, সেখানে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে এ খাতের শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছে। তাদের অস্বাভাবিক উত্থান জুয়াকেও হার মানিয়েছে। কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম চার মাসে প্রায় আট গুণ বাড়ানো হয়েছে।
অভিযোগ ওঠে, সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র শেয়ার কিনে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বিমা কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দেয়। এরপর বেশি দামে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে কেটে পড়ে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চোখের সামনেই এমন আয়োজন চলে। কিন্তু এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
এমআই/এমএআর