* ১৩ টাকার শেয়ারের দাম ১৮৩ টাকা
* ব্যাংক ঋণ ৩০০ কোটি টাকা
* তমিজউদ্দিনে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ, বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা

তিন মাস আগে তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল লিমিটেডে সাত লাখ টাকা বিনিয়োগকারী বর্তমানে কোটিপতি! অনেকটা আলাদিনের চেরাগের মতো এ কোম্পানির শেয়ার। ফলে অল্প টাকা বিনিয়োগ করে স্বল্প সময়ে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছেন কোম্পানিটির সাড়ে তিন কোটি শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা।

যদিও পুরো প্রক্রিয়াটিকে অবৈধ বলে দাবি করছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। দ্রুত এ শেয়ারটির কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি নতুন করে এ কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, চলতি বছরের ১৩ জুন ছোট-মূলধনী কোম্পানিটি ওভার দ্যা কাউন্টার মার্কেট (ওটিসি) থেকে মূল মার্কেটে লেনদেন শুরু করে। ওই দিন ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ১৩ টাকা ২০ পয়সা। তিন মাসে ১৭০ টাকা ৫০ পয়সা বেড়ে গত ৮ সেপ্টেম্বর শেয়ারটির লেনদেন হয় ১৮৩ টাকা ৭০ পয়সা। যা শতাংশের হিসাবে সাড়ে ১৪০০ শতাংশ বা ১৪ গুণের বেশি। এতে ৩০ কোটি ৬ লাখ ৫ হাজার টাকার কোম্পানিটির বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫০২ কোটি ৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা।

ডিএসইর তথ্য মতে, গত ১৩ জুন যে বিনিয়োগকারী এ কোম্পানির সাত লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকার শেয়ার কিনেছেন এখন তিনি কোটিপতি। অর্থাৎ গত বুধবার তার শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে এক কোটি ১১ লাখ ৬৫০ টাকা। এই দাম বৃদ্ধি হয়েছে কারসাজির মাধ্যমে। ফলে কোম্পানির শেয়ারের মূল্য-আয় অনুপাত (পিই রেশিও) দাঁড়িয়েছে ১৫৫ টাকা ৬৮ পয়সায়। এই দাম বৃদ্ধির কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এছাড়া ডিএসইকেও বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশনা দিয়েছে বিএসইসি।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোম্পানিটির প্রবৃদ্ধি ভালো নয়। বড় কোনো মুনাফার সম্ভাবনাও নেই। তারপরও ১৩ টাকার শেয়ার ১৮৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে এখানে কারসাজি হয়েছে। যেসব বিনিয়োগকারী এই কোম্পানির শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিষয়টি নিয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শেয়ারটি ওটিসি মার্কেটের থাকায় দাম কম ছিল। মূল মার্কেটে আসার পর শেয়ারটির দাম কিছুটা বৃদ্ধি যৌক্তিক ছিল। কিন্তু অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এটা যুক্তিসংগত নয়। এর পেছনে কোনো মূল্যসংবেদনশীল তথ্য গোপন করা হয়েছে কি না বা কারসাজি হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অস্বাভাবিক হারে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে ডিএসইর একাধিক পরিচালক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে আরও বেশি মুনাফা হবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাদের কাছে মূল্য সংবেদশীল তথ্য নেই। তারপরও দাম বাড়ছে। তার মানে এখানে কারসাজি হচ্ছে।

ডিএসইর তথ্য অনুসারে, ১৯৯২ সালে বস্ত্র খাতে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানির মোট শেয়ারের পরিমাণ ৩ কোটি ৬৪ লাখ ৭৬৭টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে রয়েছে কোম্পানির ৫৬ দশমিক ২২ শতাংশ শেয়ার, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৪৩ দশমিক ১৬ শতাংশ শেয়ার আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে দশমিক ৬২ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটি বর্তমানে জেড ক্যাটাগরিতে রয়েছে।

এই কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রথম দফায় বাড়ে ১৩ জুন থেকে ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে। এ সময়ের মধ্যে তমিজউদ্দিনের ১৩ টাকার শেয়ার ৭৭ টাকা বেড়ে ৯০ টাকা ৩০ পয়সায় দাঁড়ায়। এরপর দ্বিতীয় দফায় গত ২৪ আগস্ট থেকে দাম বাড়তে শুরু করে। যা গত ৮ সেপ্টেম্বর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৩ টাকা ৭০ পয়সায়।

কোম্পানিটি ২০১১ সালে ১০ শতাংশ, ২০১৭ সালে ২০ শতাংশ, ২০১৮ সালে ২৫ শতাংশ, ২০১৯ সালে ২৭ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ আর ২০২০ সালে ১০ শতাংশ অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি ১ টাকা নগদ লভ্যাংশ দেয়।

যেভাবে হলো কারসাজি

১৩ জুন থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত শেয়ারটির মোট ৫৫ দিন লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ১২ দিনে কোম্পানির ১ হাজার ৮৩৬টি শেয়ার মাত্র ৪৯ হাজার টাকায় লেনদেন হয়। এই ১২ দিনের মধ্যে চার দিন কোনো শেয়ার লেনদেন হয়নি কিন্তু শেয়ারের দাম ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়।

কারসাজি চক্রটি প্রতিদিন, একদিকে সার্কিট ব্রেকারের চেয়ে বেশি দামে শেয়ার কেনার অর্ডার দিয়ে রাখত, অপরদিকে এ দামে কোনো শেয়ার বিক্রির অর্ডার দিত না। এভাবেই প্রথম দফায় ১৩ টাকা থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে।

দ্বিতীয় দফায় মূল্য সংবেদনশীল তথ্য অর্থাৎ কোম্পানিটি ‘ভালো লভ্যাংশ দেবে’ এবং কোম্পানির ‘ব্যবসা সম্প্রসারণ করবে’ এই তথ্য বাজারে ছড়িয়ে দেয় চক্রটি। দাবি করা হয়, শেয়ারটির দাম ২০০-২৫০ টাকায় পৌঁছাবে। আর তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। শেয়ারের দাম বাড়তে শুরু করে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) শেয়ারটি লেনদেন হয় ১৮৫ টাকায়। এ সুযোগে শেয়ার বিক্রি শুরু করে চক্রের সদস্যরা।  ওই দিন কোম্পানির ৭৭ হাজার ৫৭০টি শেয়ার লেনদেন হয় ১ কোটি ৪৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। যদিও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখনো কোম্পানিটির শেয়ার কিনছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। কেন দাম বাড়ছে তাও আমরা বলতে পারব না। তবে সম্প্রতি পর্ষদ সভায় তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল কোম্পানির ভারসাম্য, আধুনিকীকরণ, পুনর্বাসন এবং সম্প্রসারণে (বিএমআরই) ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কোম্পানিটি নিজস্ব সম্পদ এবং ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে বিনিয়োগের অর্থায়ন করবে। এই তথ্য আমরা বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছি।

এমআই/এসকেডি/এইচকে