বানকো সিকিউরিটিজের অর্থ সরিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক তিনি
গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ মাথায় নিয়ে বিনিয়োগকারীদের কাঠগড়ায় বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেড। পুঁজিবাজার থেকে ৬৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আব্দুল মুহিত ও পাঁচ পরিচালক দুর্নীতির মামলার আসামি হয়েছেন।
মামলার প্রধান আসামি হিসেবে আব্দুল মুহিত ইতোমধ্যে গ্রেফতার হলেও গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের নেপথ্যের কারিগর বলা হচ্ছে মুহিতের বড় বোনের ছেলে এজাহারভুক্ত অপর আসামি শফিউল আজম মুন্নাকে। যদিও পরিচালনা পর্ষদের প্রায় সবাই মুহিতের নিকট আত্মীয়।
বিজ্ঞাপন
পদাধিকার বলে আব্দুল মুহিত বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের প্রধান হলেও শফিউল আজম মুন্নাই মূলত প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার মূল দায়িত্ব পালন করেছেন। ভাগিনার ওপর আস্থা রেখে মুহিতও অধিকাংশ সময় লন্ডনে থাকতেন। অন্যদিকে মামার আস্থার সুযোগ নিয়ে শফিউল আজম ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিনিয়োগকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ সরিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এসব তথ্যের প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে।
সূত্র জানায়, বানকো সিকিউরিটিজ কোম্পানির মালিকানায় যদিও ছয় জনের নাম রয়েছে। কিন্তু কোম্পানির একক নেতৃত্বে ছিলেন আসামি শফিউল আজম মুন্না। তিনি বানকোর চেয়ারম্যান আব্দুল মুহিতের আপন বড় বোনের ছেলে। ভাগ্নে হওয়ায় মুন্নাকে বানকোর মূল দায়িত্ব দিয়েছিলেন মামা মুহিত। অন্যদিকে বেশ কয়েক বছর আগে অপর আসামি ও মুহিতের বড় ভাই মুনিম চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ছেলের কাছে চলে যাওয়ায় মুন্না সম্পূর্ণ নিজের খেয়াল খুশি মতো প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের সূত্রে আরও জানা যায়, বানকো সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের বিও অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে আত্মসাৎ করে শফিউল আজম মুন্না অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে। গড়েছেন নিজের নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান। কাগজপত্রে ওই সব প্রতিষ্ঠানের মালিক মুন্না নিজে, তার স্ত্রী মিসেস বুশরা চৌধুরী এবং তার মা আফিয়া চৌধুরী। এসব ব্যবসার আড়ালে শফিউল আজম মুন্না বিদেশে প্রচুর অর্থ পাচার করেছেন বলেও প্রাথমিকভাবে প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে। নিজের মালিকানাধীন সুব্রা সিস্টেমস নামের একটি কোম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য আমদানির নামে বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। পাসপোর্ট পরীক্ষা করেও মুন্নার দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া ও ব্যাংককে আসা-যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। দুদকের তদন্তে শফিউল আজম মুন্নার নামে এ পর্যন্ত তিনটি পাসপোর্টের সন্ধান মিলেছে বলেও জানা গেছে।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া সম্পদের বর্ণনায় দেখা গেছে, শফিউল আজম মুন্নার নামে গুলশান-১ এর বেনচুরা রোজাভিলা, গুলশান-২ এর আইকন (বিটিআই), সেগুনবাগিচার কনকর্ড টাওয়ার ও শান্তিনগরের মেহমান টাওয়ারে ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া ধানমন্ডিতে ফুট ল্যাব হোটেল, মিরপুর বেনারসি পল্লীতে কাপড়ের দোকান ও গাজীপুরে ২ একর জমির মালিক তিনি। এ পর্যন্ত বিভিন্ন নথিপত্রে তার নামে দুটি হায়েস গাড়ির (ঢাকা মেট্রো চ - ৫৬-০২২৬ ও ঢাকা মেট্রো চ - ৫২ – ১৫৫২) সন্ধান পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, মুন্না সুব্রা সিস্টেমস লিমিটেড ও এমুলেট ফার্মাসিউটিকেল কোম্পানি নামে দুটি প্রতিষ্ঠানেরও মালিক। এছাড়া শফিউল আজম মুন্নার নামে গাজীপুর, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, শ্রীপুর, মাওনা, কাপাসিয়াসহ আরও অনেক জায়গায় বেনামে শত শত একর জমি কিনেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মামলার আসামি ও বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের পরিচালক শফিউল আজম মুন্নার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে দুর্নীতির অভিযোগে গত ৫ জুলাই বানকো সিকিউরিটিজ ও এর পরিচালকদের সংশ্লিষ্ট আরও ১০টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- বানকো সিকিউরিটিজ, বানকো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, সুব্রা সিস্টেমস, সুব্রা ফ্যাশনস, বানকো পাওয়ার, বানকো এনার্জি জেনারেশন, বানকো স্মার্ট সল্যুশন, ক্লাসিক ফুড ল্যাব, অ্যামুলেট ফার্মাসিউটিক্যালস ও সামিট প্রপার্টিজ লিমিটেড।
গত ২৮ জুন পুঁজিবাজার থেকে ৬৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল মুহিত ও পাঁচ পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ সংস্থাটির উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নুর আলম সিদ্দিকী বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। ওই দিন পালিয়ে লন্ডনে যাওয়ার সময় আসামি আব্দুল মুহিত গ্রেফতার হন।
বর্তমানে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আতিকুর রহমান ও হুমায়ুন কবীরের সমন্বয়ে একটি টিম তদন্তের দায়িত্ব পালন করছেন। জানতে চাইলে তারা তদন্ত পর্যায়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
দুদকের মামলার আসামিরা হলেন- বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল মুহিত, পরিচালক শফিউল আজম, ওয়ালিউল হাসান চৌধুরী, নুরুল ঈশান সাদাত, এ মুনিম চৌধুরী ও পরিচালক জামিল আহমেদ।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বানকো আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের লেনদেন নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়। পরে চলতি বছরের ৭ জুন বিশেষ পরিদর্শনে ডিএসই সম্মিলিত গ্রাহক অ্যাকাউন্টে ৬৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৯ হাজার ১৩৩ টাকার ঘাটতির প্রমাণ পায়। বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের মালিক পক্ষ বিনিয়োগকারীদের অর্থ ও শেয়ার আত্মসাৎ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। বিনিয়োগকারীদের সমন্বিত হিসাবের ৬৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ১৫ জুন থেকে ডিএসইতে বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ। একই সঙ্গে ব্রোকার হাউজটির পরিচালক ও পরিবারের সদস্যরা যাতে বিদেশে যেতে না পারেন, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ব্রোকার হাউজ সূত্রে জানা যায়, অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ ও তার আত্মীয়স্বজনের বেশকিছু বিও অ্যাকাউন্ট ছিল হাউজটিতে। এক থেকে দেড় বছর ধরে শেয়ার বিক্রি করেও টাকা উত্তোলন করতে পারেননি তিনি। তখন তিনিসহ বিনিয়োগকারীরা ডিএসইর শরণাপন্ন হন।
এ বিষয়ে আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্রোকার হাউজ বন্ধে করে দেওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ডিএসই ও বিএসইসি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় আজ বানকোর বিনিয়োগকারীরা পথে বসেছেন। হাউজটিতে আমারও বিও অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আমি শেয়ার বিক্রি করেছি। কিন্তু এখনও টাকা পাচ্ছি না। তাদের পেছনে ঘুরছি। আমি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান চাই।
আরএম/এসএসএইচ