পুঁজিবাজারে প্রতারণা চক্রের তিন শতাধিক আইটেমধারী চিহ্নিত
‘ইতিহাসের সেরা আইটেম এই মাত্র পেলাম ইনবক্স করুন’, ‘এক সপ্তাহে ডাবল হবে’, ‘অল্প কিছু টাকার বিনিয়োগ পাল্টে দিতে পারে আপনার জীবনটাই, পেতে ইনবক্স করুন’ এবং ‘ব্লক সেল করতে চাইলে ইনবক্স করেন’ এভাবে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে স্ট্যাটাস দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করছে শেয়ারবাজার নিয়ে কারসাজি করা চক্র। আইটেম দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে কয়েকটি চক্র। এই চক্রের কবল থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় মাঠে নেমেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
কমিশনের একটি টিম চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত সময়ে পুঁজিবাজার নিয়ে পরিচালিত ফেসবুক পেইজ ও গ্রুপগুলো খতিয়ে দেখছেন। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক পেইজ ও তিন শতাধিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পেইজগুলোকে আইনের আওতায় আনতে বিটিআরসিকে পর্যায়ক্রমে চিঠি দিচ্ছে কমিশন।
বিজ্ঞাপন
বিনিয়োগকারী এস এম আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক সপ্তাহে রবির শেয়ার ৭০ টাকায় যাবে বলে আইটেম দিয়ে আমার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়েছেন ‘সুমন ডিএসই’ নামের ফেসবুক অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তি। আমি তার কথায় রবির শেয়ার কিনে ধরা খেয়েছি। ৪০ হাজার টাকার রবি আজিয়াটার শেয়ার কিনে এখন দেখি ৩২ হাজার ৭৯৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ৮ হাজার টাকা লোকসান।
ফেসবুকে আইটেম দেওয়ার কথা বলে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করছে সুরাইয়া সুমি, নাইমা ফারহান এবং মিজানুর রহমান ইত্যাদি নামের ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে মুনাফা তুলে নিচ্ছেন তারা। ফলে সুমনের মতো ভুক্তভোগী হচ্ছেন অনেকে।
বিএসইসির তথ্য মতে, সুরাইয়া সুমি ডিএসই (Suraiya sumi dse) লিখেছেন ‘পুঁজিবাজারের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আইটেম এইমাত্র হাতে পেলাম। ২০ লাখ টাকা নূন্যতম বিনিয়োগ করতে চাইলে ইয়েস (yes) লিখে ইনবক্স করুন’।
সপ্তাহ খানেক আগে অর্থাৎ গত ৭ জুন একইভাবে স্ট্যাটাস দেন, ‘পুঁজিবাজারের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আইটেম এইমাত্র হাতে পেলাম। ৫ লাখ টাকা নূন্যতম বিনিয়োগ করতে চাইলে লিখে ইনবক্স করুন।’
গত ১০ জানুয়ারি ‘ওএএল (অলিম্পিক এক্সসেসরিজ লিমিটেডের শেয়ার) ৭০ টাকা হবে, টাকা থাকলে কিনে রাখেন সবাই’ লিখে পোস্ট করা হয়। বর্তমানে শেয়ারটি দাম সাড়ে ৮ টাকা। গত নয় মাসের শেয়ারটি সর্বোচ্চ ৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ ভুয়া তথ্য দিয়ে বিনিয়োগারীদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। জেনে শুনে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে চক্রটি।
একই আইডি থেকে গত অক্টোবর মাসে পোস্ট করা হয়, ‘আগামী কালকের হলটেড আইটেম যাদের লাগবে তারা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেন, মাত্র সাত দিনে ডাবল হবে’ সুমি বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জোট গ্রুপের সদস্য। তার মতোই আরও ১৫-২০ জন সদস্য গ্রুপটিতে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করছেন।
ডিএসই প্রফিট ক্লাব নিউ (DSE Profit Club New) গ্রুপের সদস্য নাইমা ফারহানা (naima farhana) ১৪ জুন পোস্ট করেছেন ‘(npolymar) এনপলিমার, সাফকো (safkospinn) আজও হলটেড। নতুন আইটেম মুনুসপোল, পেপারপো সব হলট হলট চলছে’।
এই ব্যক্তির পোস্টে মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান মন্তব্য করেন, ‘ওরে বাটপার সাফকো ২০১৯ এর আইটেম। সেই সময় তুমি ১০০০ টাকা যাবে বলেছ। ২০২১ এর আইটেম সাফকো হলো কবে। ওরে চিটার তোমার আইটেম ন্যাশনাল পলিমারে জীবন পাল্টে যাবে কিন্তু কিছু লোক বোকার স্বর্গে বাস করে ন্যাশনাল পলিমার কিনে মাইনকা চিপায় ধরা পড়েছে আর বের হতে পারবে না।’
গত ২ মে নাইমা ফারহানা আরেকটি স্ট্যাটাস দেন, ‘আমার আইটেম পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স অন্তবর্তীকালীন নগদ লভ্যাংশ দিলে একদিনে ২৫ শতাংশ বাড়ল। সাফকো, ভিএফএস, কেপিসিএল, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট সব হল্ট। পরের আইটেম চাইলে ইয়েস লিখে ইনবক্স দিন। যারা ইনবক্স করবেন পাবেন।’ ৭ মে তিনি পোস্ট করেন, ‘১০০ গুণ আইটেম চাইলে ইনবক্স করেন।’
তার আগে গত ৩০ এপ্রিল পোস্ট করেন, ‘অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। ১৪ কর্মদিবসে দ্বিগুণ হবে একটা আইটেম। আইটেম চাইলে ইয়েস লিখে ইনবক্স দিন।’ পোস্টটিতে ১৬০ ব্যক্তি কমেন্ট করেছেন। একই দিন তিনি আবারও পোস্ট করেন, ‘অল্প কিছু টাকার বিনিয়োগ পাল্টে দিতে পারে আপনার জীবনটাই। ইনবক্স-এ দেওয়া হবে ওকে লিখে যারা ইনবক্স করবেন তারাই পাবেন।’
২৩ মার্চ পোস্ট করেন, ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি ন্যাশনাল পলিমার কেউ ব্লক সেল করতে চাইলে ইনবক্স করেন। কমপক্ষে ১০ হাজার শেয়ার হতে হবে। রেট ৪৮ টাকা দেব।’
একই গ্রুপের সদস্য মিজানুর রহমান শুক্রবার (১৮ জুন) পোস্ট করেন, রোববারের হল্ট আইটেম একটি প্লাস ২ হট আইটেম রেডি আছে। এটি টানা হল্টেড হবে। আইটেমে পেতে ইনবক্স করুন/মেসেজ দিন।’ এর দুদিন আগে অর্থাৎ ১৬ জুন ‘ডিএসইর সর্বশেষ টানা হল্টেড আইটেম পেতে হলটেড আইটেম লিখে ইনবক্সে মেসেজ দিন’ লিখে পোস্ট করেন তিনি।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জোট গ্রুপের সদস্য জমিস উদ্দিন ১৬ জুন পোস্ট করেন, ‘মুন্ন সিরামিক ১০০তে মানবে?’ একইভাবে গত ৯ জুন পোস্ট করেন, ‘মুন্নু সিরামিক হলটেড হবে মনে হচ্ছে…….’।
নুনী আলিফা (Nooni alif) ৬ জুন পোস্ট করেন, ‘মার্কেট স্থিতিশীল, ইনশাল্লাহ এআইবিএল ফাস্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড খুব তাড়াতাড়ি বাড়বে।’ গত ১৫ জুন তিনি পোস্ট করেন, ‘ব্যাংক বাড়বে ইনশাল্লাহ। আপনারা স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক দেখতে পারেন। যেভাবে ইন্স্যুরেন্স বেড়েছে, ৯ টাকার ব্যাংক ৮ টাকা হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাছাড়া ব্যাংকিং সেক্টরেরর মানি ফ্লো বাড়া শুরু করছে।’ কিন্তু বাস্তবে তার কোনো মিল নেই। ফলে বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হচ্ছেন।
অর্থনীতিবদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য কেবল কোম্পানি কর্তৃপক্ষই জানেন। কিছু কিছু বিনিয়োগকারী আছেন, যারা নিজের হাতের শেয়ার বিক্রির জন্য বিভিন্ন গ্রুপে আইটেম আছে, এক সপ্তাহের ডাবল হবে। আপনারা কেনেন বলে কারসাজির মাধ্যমে কয়েক টাকা বাড়িয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে হাতিয়ে নেন টাকা। আর অল্প সময়ের অধিক মুনাফা পাওয়ার আশায় বিনিয়োগ করে লোকসানে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। এ বিষয় কমিশনের উদ্যোগ পুঁজিবাজারের কারসাজি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারে উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করতে চায় একটি চক্র।
আরেকটি চক্র রয়েছে, যারা আইটেম দেওয়ার কথা বলে বিকাশ, নগদ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এমন বেশ কিছু গ্রুপ ও ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে আমাদের তদন্ত কমিটি। কিছু চিহ্নিত পেইজ ও ব্যক্তিদের তালিকা গোয়েন্দা সংস্থা ও বিটিআরসির কাছে দেওয়া হবে। তাদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে গুজব সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তাদেরও আইনের আওতায় এনে কঠোর বিচার করা হবে।
রেজাউল করিম বলেন, ফেসবুকে গুজব সৃষ্টির অপরাধে কয়েকটি পেইজ বন্ধ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
পুঁজিবাজার গুজব সৃষ্টিকারী চক্র ধরতে গত ২৪ মে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে বিএসইসি। বিএসইসির পরিচালক রাজিব আহমেদের নেতৃত্বে কমিটির রয়েছেন সিডিবিএলের এপ্লিকেশন সাপোর্ট বিভাগের প্রধান মো. মঈনুল হক, ডিএসইর সিস্টেম অ্যান্ড মার্কেট অ্যাডমিন বিভাগের প্রধান আবু নুর মুহাম্মদ হাসানুল করিম ও ডিএসইর সার্ভেইল্যান্স বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার মো. মাহফুজুর রহমান। তদন্ত কমিটিকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়।
এমআই/এসএসএইচ