প্রথমে বিধিনিষেধ, এরপর ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেওয়ার ইস্যুকে কেন্দ্র করে এপ্রিলের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছে বেশি। এই সময়ে দেশি-বিদেশি কোম্পানির শেয়ারের দাম কমলেও বেড়েছে বিমা কোম্পানির শেয়ারের দাম। তাতে দশটি বিমা কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের হাতে মুনাফা বাবদ এসেছে ৭২০ কোটি টাকা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমার শেয়ারে টাকা উড়ছে, যে বিনিয়োগকারীরা বিমা কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন, তারা টাকা ধরতে পেরেছেন। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দায়িত্বে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম আসার পর থেকে বিমা কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামনে বিমা কোম্পানিগুলো ভালো করবে। কারণ সম্পদের তুলনায় অর্থনীতিতে বিমা খাতের অবদান কম। ফলে এখনো ভালো করার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

করোনার কারণে গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা কমেছে। বছর শেষে এসব কোম্পানির মুনাফাও আগের বছরের তুলনায় কমেছে। এবছরও করোনা চলছে, ফলে কোম্পানির মুনাফা হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তবে কারসাজি চক্রের দখলে রয়েছে বিমা কোম্পানির শেয়ার। ফলে এসব শেয়ারে মুনাফা হবেই বলে ধরে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এ মুহূর্তে বিমায় বিনিয়োগের আগে দেখতে হবে কারসাজি চক্রের বিনিয়োগ রয়েছে কি না। নতুন করে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমা কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে। এ কারণে সরকার ঘোষিত লকডাউনে পুঁজিবাজার বন্ধ থাকার গুজব কিংবা সব কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে দরপতনের সময়ও বিমা কোম্পানির দাম বেড়েছে।  বিনিয়োগকারীদের লাভ হয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু ঝুঁকি রয়েছে এসব কোম্পানির শেয়ারে।

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইর) তথ্য অনুসারে, ১ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত মোট আটদিন লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে চারদিন উত্থান আর চারদিন পতন হয়েছে। এই আটদিনের ছয়দিনই বিমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেড়েছে। এসময়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৫০টি বিমা কোম্পানির শেয়ারের অধিকাংশেরই দাম বাড়ে। দাম বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল শেয়ারপ্রতি ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার। গত ৪ এপ্রিল কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ৯৫ টাকা। সেখান থেকে ২৯ টাকা ৮০ পয়সা বেড়ে ১৩ এপ্রিল শেয়ার বিক্রি হয়েছে ১২৪ টাকা ৮০ পয়সায়। তাতে এ কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের মোট মুনাফা হয়েছে ৮৮ কোটি ৫১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৯ টাকা।

একইভাবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৭৪ টাকা থেকে ২২ টাকা ৬০ পয়সা বেড়ে ৯৬ টাকা ৬০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। তাতে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হয়েছে ৯৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

শেয়ারপ্রতি ২১ টাকা করে দাম বাড়ায় সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা হয়েছে ৮৪ কোটি ৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৪৫ টাকা। ১৫ টাকা দাম বাড়ায় কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের বিনিয়োগকারীদের ৬০ কোটি ৭৬ হাজার ৬২০ টাকা মুনাফা হয়েছে। ১৪ টাকা দাম বাড়ায় ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশের মুনাফা হয়েছে ৫২ কোটি ৩৯ লাখ ২০ হাজার ৯২২ টাকা।

১২ টাকা দাম বাড়ায় পাইওনিয়র ইন্স্যুরেন্সের বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হয়েছে ৮৩ কোটি ৯৭ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে ১২ টাকা বাড়ায় ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের মুনাফা হয়েছে ৪৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ১১ টাকা বেড়ে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হয়েছে ৪৬ কোটি ৯২ লাখ ৫৫ হাজার ৭২১ টাকা।

এছাড়াও ১০ টাকা করে শেয়ারের দাম বাড়ায় ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের মুনাফা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্সের ৪০ কোটি ৫৫ লাখ ১৭ হাজার ৬৩০ টাকা এবং রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ৭৬ কোটি ৬৬ লাখ ৫৪ হাজার ১২০ টাকার।

ডিএসইর তথ্য মতে, গত ৪ এপ্রিল কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম ছিল ৩৩ টাকা। সেখান থেকে ১৫ টাকা ৫০ পয়সা বেড়ে শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সায়। ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৩৪ টাকা ৮ পয়সা থেকে ১৪ টাকা ৮২ পয়সা বেড়ে ৪৮ টাকা ৯০ পয়সায় কেনা-বেচা হয়েছে। একইভাবে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৫৬ টাকা ৩ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৫৭ পয়সা বেড়ে ৬৮ টাকা ৬০ পয়সা দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৩৮ টাকা ৯ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৬১ পয়সা বেড়ে ৫০ টাকা ৭০ পয়সায়, ২৯ টাকা থেকে ১১ টাকা ২০ পয়সা বেড়ে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৪০ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স শেয়ার ৩২ টাকা ৪ পয়সা থেকে বেড়ে ৪২ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। এছাড়াও ২৮ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১০ টাকা বেড়ে গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ার ৩৮ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।

এদিকে দশ টাকার কমমূল্যের শেয়ারের দাম বেড়েছে কয়েকটি কোম্পানির। এগুলো হচ্ছে -অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, সেন্ট্রাল, সিটি জেনারেল, দেশ জেনারেল, ইস্টার্ন, ইস্টল্যান্ড, এক্সপ্রেস, ফেডারেল, গ্রিন ডেল্টা, ইসলামী কমার্শিয়াল, জনতা, কর্ণফুলী, মেঘনা, মার্কেন্টাইল, নিটল, প্যারামাউন্ট, পিপলস প্রগতি, প্রাইম, পূরবী জেনারেল, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স এবং রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এছাড়াও রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, তাকাফুল ইসলামি ইন্স্যুরেন্স এবং ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।
 
আইডিআরএর তথ্য মতে, বিদায়ী বছরের (৩১ ডিসেম্বর ২০২০) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত-অতালিকাভুক্ত সব বিমা কোম্পানির প্রিমিয়াম বাবদ আয় হয়েছে ১৩ হাজার ৮২১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে হয়েছিল ১৪ হাজার ৩১৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। করোনার বছরের বিমা কোম্পানির প্রিমিয়াম বাবদ আয় কমেছে ৫০০ কোটি টাকা। তাতে আগের বছরের তুলনায় মুনাফাও কমেছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা কোম্পানিগুলোর। তবে এসব কোম্পানির শেয়ারে দাম দফায় বাড়ছে।

এই সময়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দাম বেড়েছে সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির। এই কোম্পানির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন। তিনি বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) চেয়ারম্যান। শেখ কবির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শেয়ারের দাম বাড়ছে এটা ঠিক আছে। কিন্তু কেন বাড়ছে তা বলতে পারব না।

তিনি বলেন, আমার কোম্পানির তো ব্যবসা বাড়েনি। তারপরও শেয়ারের দাম বাড়ছে। কেন বাড়ছে, কারা বাড়াচ্ছে এটি দেখা উচিত।

করোনাভাইরাসের প্রকোপ রোধে সরকার ঘোষিত প্রথম দফা বিধিনিষেধকে কেন্দ্র করে ১ এপ্রিল ও ৪ এপ্রিল দুদিন পুঁজিবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। তাতে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কমেছে ১৫ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। এ দুদিন সব শেয়ারের দাম কমলেও বিমা খাতের শেয়ারের দাম বেড়েছে।
এরপর বিএসইসি প্রায় এক বছর পর ৬৬টি কোম্পানির শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়। এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে ৮ ও ১১ এপ্রিল দরপতন হয়। এই দরপতনেও বিমা কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। পুঁজিবাজারে পতন রোধে অবদান রেখেছে।

এমআই/আরএইচ/এসএম/জেএস