জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পুঁজিবাজারে যাতে পতন না হয় সে লক্ষ্যে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান হাফিজ মোহাম্মদ হাসান বাবু। তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচনকে উদ্দেশ্য করে আমাদের পুঁজিবাজার যাতে পতনের দিকে না যায়, আমরা উত্থানটাকে যেন সুন্দরভাবে ধরে রাখতে পারি, সেই প্রেক্ষাপটে সবাই কাজ করছি।

মঙ্গলবার (১১ জুলাই) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) অডিটোরিয়ামে পুঁজিবাজার নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে এ কথা বলেন তিনি। অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে ইআরএফ।

ডিএসইর চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে প্রতিটি দেশে মানুষের একটা চিন্তা থাকে। সামনে রাজনৈতিক একটা অবস্থান রয়েছে। হয়ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা সংশয় থাকে, অনেকে হয়ত দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন। তারপরও আমি বলব, বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেট এখনো সুন্দর অবস্থানে আছে।

দেশের পুঁজিবাজারে চারটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে উল্লেখ করে ডিএসই চেয়ারম্যান বলেন, এর মধ্যে রয়েছে বাজারের গুণগত সম্প্রসারণ নিশ্চিত করা, পণ্য বৈচিত্র্য করা, বিনিয়োগকারী বৈচিত্র্য করা ও সুরক্ষা এবং রেগুলেটরি বিষয়।

বাজারের গুণগত সম্প্রসারণের বিষয়ে বাবু বলেন, ফাস্ট ট্র্যাক আইপিও প্রক্রিয়া কঠোর শর্ত সাপেক্ষে বাস্তবায়ন করতে হবে। ইনস্টিটিউশনাল মার্কেট বা প্রফেশনাল মার্কেট অ্যান্ড রিটেল মার্কেট আলাদা করতে হবে। বিদেশি এবং মানসম্পন্ন সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্তির ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে বিদেশে যে ধরনের রোড শো করা হয়েছে, স্থানীয় পর্যায়েও সেই ধরনের রোড শো করতে হবে।

বিনিয়োগকারী বৈচিত্র্যময় করা ও সুরক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা বিমা পলিসি প্রবর্তন করতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নির্দেশিকা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।

রেগুলেটরি বিষয়ে ডিএসইর চেয়ারম্যান বলেন, তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ট্যাক্স ব্যবধান রাখতে হবে। মার্কেট মেকার প্রবর্তন করতে হবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে বিদ্যমান আইন সংশোধন করা যেতে পারে এবং তাদের পুঁজিবাজারে আসতে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তিনি বলেন, বাজারে একটু শক্ত অবস্থান দেখতে পেলে, আমরা যদি বুঝি মানুষের পুঁজি নিরাপদ বা অনুভব করি বিপদে পড়বে না, সঙ্গে সঙ্গে আমরা ফ্লোর প্রাইস তুলে দেব। খুব তাড়াতাড়ি ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার চেষ্টা আমাদের মধ্যে আছে।

তিনি বলেন, তিন বছরে একটা মুহূর্তও স্বাভাবিক সময় পাইনি, সব সময় প্রবলেম (সমস্যা)। আগামী ছয় মাস পর নির্বাচন। তিন বছর করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সামনের ছয় মাস নির্বাচন। বাজারে স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ তৈরি করব, সেই সুযোগও পাচ্ছি না। এ রকম একটা মুহূর্তে আমরা যে মার্কেট ধরে রেখেছি, রাখার চেষ্টা করছি, এটা খুব কঠিন কাজ। এত স্টেকহোল্ডার, এত রকমের মানুষ, বিনিয়োগকারী, এত রকমের সমস্যা ব্যালান্স করা বাস্তবতার নিরিখে সত্যিই কঠিন। তারপরও আমরা সবাই চেষ্টা করছি।

অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হাসান ইমাম বলেন, পুঁজিবাজার বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে সে অবস্থা থেকে আগামী ছয় মাস পর ভালো হবে, ঘুরে দাঁড়াবে। এখন দরকার বিশেষ বিশেষ পণ্য দিয়ে বাজারকে সাজানো, আমরা সেই লক্ষ্যে মিউচ্যুয়াল ফান্ড নিয়ে কাজ করছি।

তিনি বলেন, লম্বা সময় উত্থান হলে পতন হবে এটাই স্বাভাবিক। ফ্লোর প্রাইস দেওয়ার কারণে ভালো ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেও ব্রোকার হাউজ এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও আটকে আছি। আমরা নির্ধারিত কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করতে পারছি না। ফলে তারল্যের অভাবে ওষুধ, ব্যাংক, বিমা কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগও করতে পারছি না।

গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান।

পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম। তিনি বলেন, পুঁজিবাজার হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জায়গা। দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে হলে সেই জায়গায় যেতে হবে। এক্ষেত্রে বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। নৈতিক দায়িত্বের অংশ থেকে বহুজাতিক কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে।  

এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল বলেন, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজার, সেই দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখছে। কিন্তু আমাদের দেশের পুঁজিবাজার সেই তুলনায় অর্থনীতিতে অবদান একেবারেই কম।

ফ্লোর প্রাইস নিয়ে সমালোচনা করে তিনি বলেন, বিশ্বের সব দেশের পুঁজিবাজারে ভালো ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত হয় ব্লুচিপ কোম্পানি। আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে এখন আমি হতাশ। তিনি বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে এই শেয়ারগুলোতে বিনিয়োগ করে আটকে আছি। প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও কেনা-বেচা করতে পারছি না।

দেশের অনেক অলস টাকা পড়ে আছে। এই টাকা পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে পারভেজ তমাল বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের নিশ্চয়তা পেলে নতুন করে বিনিয়োগকারীরা বাজারে আসবে। সেজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা সব সবাইকে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা দিতে হবে।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইআরএফের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন ইআরএফের সদস্য মুহাম্মদ মোফাজ্জল।

এমআই/জেডএস