পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি হারিয়ে গত অর্থবছরে চলে গেছেন প্রায় ২ লাখ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও)ধারী বিনিয়োগকারী। সংশ্লিষ্টদের মতে, দুটি কারণে বাজার ছেড়েছেন তারা। এর মধ্যে একটি হচ্ছে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন আশঙ্কাজনক হারে কমেছে, তার বিপরীতে ভালো কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি।

অপরটি হচ্ছে, বছরজুড়েই সেকেন্ডারি বাজার ছিল খারাপ। এ সময়ে যে কয়েকটি শেয়ারের দাম বেড়েছে। তা থেকে কারসাজি চক্র মুনাফা তুলে নিয়েছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সেসব শেয়ারের বিনিয়োগ করে পুঁজি হারিয়েছেন।

এসব কারণে অন্তত আরও প্রায় চার লাখ বিনিয়োগকারী বাজার ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। এই বিনিয়োগকারীদের অনেকে এখন আপাতত বিও অ্যাকাউন্ট নবায়ন করবেন না। আরও খারাপ খবর হচ্ছে প্রায় ১ লাখ সক্রিয় বিনিয়োগকারী এখন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছেন বলে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ (সিডিবিএল) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে সাড়ে ১৮ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছেন। চলতি মাসে এই বিনিয়োগকারীর সংখ্যা আরও কমতে পারে। অর্থাৎ আরও বেশি কিছু বিনিয়োগকারী বাজার ছাড়বে। কারণ হচ্ছে, গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মা কিংবা রবির মত নতুন করে ভালো বড় কোনো কোম্পানি বাজারে আসছে না।

বাজারের এ চিত্রটির কথা স্বীকার করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ (ডিএসই)। তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ডিএসইর চেয়ারম্যান হাফিজ মুহাম্মদ হাসান বাবু। 

ডিএসই সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় গত অর্থবছরে আইপিওর অনুমোদন কমেছিল, সেকেন্ডারি মার্কেটের অবস্থাও ভালো ছিল না। এ কারণে বিনিয়োগকারী কমেছে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর কোম্পানিগুলোর আইপিওর অনুমোদন কম ছিল। যেসব কোম্পানি আবেদন করেছে, তার মধ্যে যোগ্য কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন হয়েছে। তবে আইপিওর অনুমোদন কম হলেও এখন ডিএসইর এসএমই বোর্ডে কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফার (কিউআইওর) অনুমোদন বেড়েছে। 

সেকেন্ডারি বাজার নিয়ে তিনি বলেন, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সেই ধাক্কা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও পড়েছে। 

তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, ডলারের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এসব কারণে বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

নির্বাহী পরিচালক বলেন, নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে গত দুই মাস ধরে সব ধরনের ইতিবাচক ধারায় ফিরছে পুঁজিবাজার। আশা করছি, এ বছরের বাকি সময়টুকু ভালো যাবে।

আশঙ্কাজনক হারে কমেছে আইপিওর অনুমোদন 

ডিএসইর তথ্য মতে, ১ জুলাই ২০২২ থেকে ৩০ জুন অর্থাৎ গত এক বছরে মাত্র ৬টি কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন হয়েছে। এর মধ্যে আইপিওর বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে নাভানা ফার্মাসিটিউক্যালস লিমিটেড পুঁজিবাজারে এসেছে। আর ফিক্স প্রাইস পদ্ধতিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে মিডল্যান্ড ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এছাড়াও বিমা খাতের কোম্পানি ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, চার্টার্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স এবং ইসলামী কমার্শিয়াল ইনস্যুরেন্স লিমিটেড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে।

অপরদিকে আগের অর্থবছরে মেঘনা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, ইউনিয়ন ব্যাংক, বিডি থাই ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, ইউনিয়ন ইনস্যুরেন্স, সেনা কল্যাণ ইনস্যুরেন্স এবং একমি পেস্টিসাইডস লিমিটেড ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। আর বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার এবং জেএমআই হসপিটালসহ ৮টি কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয়। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের দুটি কোম্পানির আইপিও কম অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

আশঙ্কাজনক হারে আইপিওর অনুমোদন কমে যাওয়ার কারণে আইপিও ব্যবসায়ীরা বিও অ্যাকাউন্ট গুটিয়ে নিচ্ছেন।

সেকেন্ডারি বাজারে মন্দা 

গত জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত বছরজুড়েই পুঁজিবাজার ছিল কারসাজি চক্রের নিয়ন্ত্রণে। এই চক্রটির মাধ্যমে বিদায়ী বছরে ছোট-ছোট তিনটি ধস হয়েছে। এই ধসের মধ্যে ওরিয়ন ইনফিউশন, রয়েল টিউলিপ সী পার্ল, জেমিনি সী ফুড, জুট স্পিনার্স, একমি পেস্টিসাইডস, এমারেল্ড অয়েল, ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং সোনালী লাইফ, মেঘনা ইনস্যুরেন্স এবং রূপালী লাইফসহ বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের কারসাজি হয়েছে। কারসাজির মাধ্যমে এসব শেয়ার কয়েকগুণ দাম বাড়িয়েছে চক্রটি। এরপর শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে মুনাফা তুলে নিয়েছে। অতিলোভী বিনিয়োগকারীরা এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

ডিএসইর তথ্য মতে, ২০২২ সালের জুলাই অক্টোবর মাসে প্রথম দফা ধস হয়েছে। এরপর ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে আরও দুই দফা ছোট ছোট ধস হয়েছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বছর দু-য়েক আগে কারসাজির ঘটনায় তদন্ত করে দুই-একটি চক্রকে জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু এখন কোনো কারসাজির ঘটনায় কোনো তদন্ত করা হচ্ছে না। এটা সত্যিই রহস্যজনক। এ কারণে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা দিনদিন কমছে। আর ভালো বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার বিমুখ হচ্ছেন।

ডিএসইর তথ্য মতে, টালমাটাল পুঁজিবাজারে গত বছর মোট ২৪১ কর্মদিবস লেনদেন হয়েছে। ৩০ জুন ২০২২ সালে ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৬ হাজার ৩৭৬ পয়েন্ট। সেখান থেকে ৩২ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৩৪৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে দেশের পুঁজিবাজারে প্রথম বারের মতো ট্রেজারি বন্ড লেনদেন শুরু হয়। তাতে বাজার মূলধন বাড়ে পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা। এই পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা বাদ দিলে বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৫ লাখ কোটি টাকায় অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কমেছে।

মূলধন কমার বছরে বিনিয়োগকারীদের মোট ১ লাখ ৯১ হাজার ৮৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকার শেয়ার কেনা-বেচা হয়েছে। অর্থাৎ দৈনিক লেনদেন হয়েছে ৭৯২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।

এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে ডিএসইতে মোট ২৪০দিন লেনদেন হয়েছিল। তাতে মোট লেনদেন হয়েছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৫৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ দৈনিক লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা।

পুঁজি কমার পাশাপাশি প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র ফ্লোর প্রাইসের কারণে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী শেয়ার কেনা-বেচা করতে পারেনি। ফলে একদিকে বাজারে প্রতিনিয়তই পুঁজি হারাচ্ছে। অন্যদিকে বিনিয়োগ করেও প্রয়োজনের সময়ে অর্থ উত্তোলন করতে না পারায় বাজারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে বাজার ছাড়ছেন।

এ বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট ডলার সংকট, টাকার অবমূল্যায়নের ফলে অনেক বিনিয়োগকারী বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বছরজুড়ে পুঁজিবাজার ছিল মন্দায়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ছিল সাইডলাইনে, অধিকাংশ ভালো কোম্পানিসহ ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ শেয়ার পড়েছিল ফ্লোর প্রাইসের মধ্যে আটকা।

যা লেনদেন হয়েছে ছোট মূলধনী ও দুর্বল মৌলভিক্তি সম্পন্ন ২০ থেকে ৪০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য কারসাজি চক্রটির সী পার্ল রিসোর্ট এবং এমারেল্ড ওয়েলসহ এসব দুর্বল ও ছোট মূলধনী কোম্পানির দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানোর পেছনের কারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করেনি কমিশন। অর্থাৎ পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে।

পুঁজিবাজার ঘুমিয়ে ছিল বলে মনে করেন মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান। তিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর বেশিরভাগ ভালো কোম্পানিই ছিল ফ্লোর প্রাইসের মধ্যে। ফলে খারাপ কোম্পানির দাম বেড়েছে। ভালো কোম্পানির চেয়ে খারাপ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ায় বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন তাই বিনিয়োগকারীরা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। এ কারণে বাজার ছেড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের বাজারমুখী করতে ভালো ভালো কোম্পানিকে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসতে হবে।

দুই লাখ বিনিয়োগকারী চলে যাওয়ার চিত্র 

শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ(সিডিবিএল) এর তথ্য মতে, ৩০ জুন ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ২০ লাখ ৫৩ হাজার ৪২২টি। সেখান থেকে ১ লাখ ৯২ হাজার ৬৪৮টি কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৬০ হাজার ৭৭৪ টিতে। অর্থাৎ প্রায় দুই লাখ বা ১ লাখ ৯২ হাজার বিওধারী বাজার ছেড়েছে।

সূত্র জানায়, ১ জুলাই দেশি বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ৬২ হাজার ৫৭টি। সেখান থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার ৫৭৫টি কমে ৩০ জানু ২০২৩ সালে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৮২ হাজার ৪৮২টিতে।

আর বিদেশি বিনিয়োগকারী ১৩ হাজার ৭৩৩টি কমে দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৪৪৭টিতে। যা ২০২২ সালের ৩০ জুন ছিল ৭৫ হাজার ১৮০টিতে।

এছাড়াও জয়েন্ট এবং অমনিবাস বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা কমেছে ৮ হাজার ৩৪০টি। সব মিলে বিদায়ী বছরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী মিলে ১ লাখ ৯২ হাজার ৬৪৮বিওধারী বিনিয়োগকারী বাজার ছেড়েছেন।   

সূত্র জানায়, ১৮ লাখ ৬০ হাজার বিওর মধ্যে বন্ধ হয়নি কিন্তু শেয়ার শূন্য রয়েছে (একটিও শেয়ার নেই) এমন বিও অ্যাকাউন্ট রয়েছে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৩৮৫টি। যা ৩০ জুন ২০২২ সালে ছিল ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮৮টি। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় এই বিও সংখ্যাও কমেছে। আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নতুন অর্থবছরের বিওর নবায়ন ফি না দিলে এসব বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধে হয়ে যাবে।

শঙ্কার চিত্র হলো, সক্রিয় বিনিয়োগকারীদের সংখ্যাও গত এক বছরের কমেছে ৭৯ লাখ ২৯৭টি। সিডিবিএলের সূত্র মতে, গত বছরের ৩০ জুন ২০২২ সালে শেয়ার রয়েছে এমন সক্রিয় বিওর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৪৯টি। সেই বিও সংখ্যা চলতি বছরের ২০২৩ জালের ৩০জুন সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫২টিতে।

২ লাখ বিনিয়োগকারী ছাড়ার সময়েও ৭৬ হাজার ৫৮টি বিও বেড়েছে।

সূত্র জানায়, ৩০ জুন ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ৭৭ লাখ ৪৫ হাজার ২৬৫টিতে। ৩০ জুন ২০২৩ সালে সেটা দাঁড়িয়েছে ৭৮ লাখ ২১ হাজার ৩২৩টিতে।

এমআই/এসকেডি