মে মাস জুড়ে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বেশি বেশি শেয়ার বিক্রি করেছেন। বিপরীতে কিনেছেন একেবারেই কম শেয়ার। ফলে ২০২২ সালের মে মাসের তুলনায় চলতি বছরের এ সময়ে বিদেশিদের লেনদেন তিনগুণেরও বেশি কমেছে। নতুন করে বাজার ছেড়েছেন ১২১ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টধারী বিনিয়োগকারী। এ নিয়ে চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৩৪৪ বিদেশি বিনিয়োগকারী বাজার ছাড়লেন।

কেবল ২০২২ সালের মে মাসের চেয়ে কম লেনদেন হয়েছে, বিষয়টি তা নয়। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের চেয়েও ৭২ কোটি টাকা কম লেনদেন হয়েছে বিদেশিদের মাধ্যমে। এপ্রিল মাসে তারা মোট ১৮২ কোটি ২১ লাখ ৩১ হাজার টাকার শেয়ার কেনা-বেচা করেছেন। মে মাসে করেছেন মাত্র ১১০ কোটি ২৭ লাখ এক হাজার টাকার শেয়ার।

বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন বিদেশিরা। এ কারণে তারা সুযোগ পেলেই শেয়ার বিক্রি করে চলে যাচ্ছেন। আস্থার সংকটের মূল কারণ হচ্ছে বাজার নিয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অযাচিত হস্তক্ষেপ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্লোর প্রাইস আরোপ, মূল মার্কেটের চেয়ে কমে ব্লক মার্কেটে শেয়ার লেনদেনের সুযোগ করে দেওয়া। অপরদিকে, বাজারে কারসাজিকারীদের দৌরাত্ম্যও বেড়েছে

এপ্রিল মাসের তুলনায় মে মাসে পুঁজিবাজার বেশ ইতিবাচক ধারায় ছিল। ফলে অনেক শেয়ার ফ্লোর প্রাইস ভেঙেছে, তার ওপরে লেনদেন হয়েছে। এ সুযোগে বিদেশিরা স্কয়ার ফার্মা, রেনেটা, বেক্সিমকো ফার্মা, গ্রামীণফোন, লাফার্জ হোলসিম, ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ও সিটি ব্যাংকের মতো ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করেছেন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন বিদেশিরা। এ কারণে তারা সুযোগ পেলেই শেয়ার বিক্রি করে চলে যাচ্ছেন। আস্থার সংকটের মূল কারণ হচ্ছে বাজার নিয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অযাচিত হস্তক্ষেপ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্লোর প্রাইস আরোপ, মূল মার্কেটের চেয়ে কমে ব্লক মার্কেটে শেয়ার লেনদেনের সুযোগ করে দেওয়া। অপরদিকে, বাজারে কারসাজিকারীদের দৌরাত্ম্যও বেড়েছে। কারসাজির বিপরীতে শাস্তি খুবই কম। আবার অনেক কারসাজির শাস্তিই হয় না। শুধু তদন্ত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশকে নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। এর প্রভাবে মার্কিন (ইউএস) ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়। অর্থাৎ ডলার বাজারের সংকট বা অস্থিরতা কাটছে না। তার ওপরে বাজারে আরোপ করা হয়েছে ফ্লোর প্রাইস। ফলে ভালো কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচা করতে পারছে না। এখন সুযোগ পেয়েই শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন সবাই।

এছাড়া পুঁজিবাজারে সুশাসন ও ভালো কোম্পানির অভাবে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে চলতি বছরের পাঁচ মাসে বিদেশিদের প্রায় সাড়ে তিনশো বিও অ্যাকাউন্ট কমেছে।

বিষয়টি স্বীকার করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এ বিষয়ে ডিএসই চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাফিজ মোহাম্মদ হাসান বাবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিষয়টি দেখেছি। কী কারণে কমছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ডিএসইর এমডিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে। তারা দ্রুত রিপোর্ট দেবেন। তার আলোকে আমরা কাজ করব।’

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশিরা ঠিক কী কারণে শেয়ার বিক্রি করছেন তা বলা মুশকিল। বাজার এখন ভালো হচ্ছে, আশা করি তারা আবারও ফিরবেন।

‘শুধু বিদেশিরা নয়, সব বিনিয়োগকারী যখন দেখেন মুনাফা করা সম্ভব তখন বিনিয়োগ করেন। এখন বাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে কম রয়েছে। তারা এখন সেসব শেয়ারে বিনিয়োগের জন্য চিন্তা করছেন। শিগগিরই তারা বিনিয়োগ করবেন।’

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডলারের বাজারে অস্থিরতার কারণে নতুন করে বিনিয়োগ থেকে বিরত রয়েছেন অধিকাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারী। পাশাপাশি ফ্লোর প্রাইসের কারণে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও নিজেদের শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না তারা। এ কারণে সুযোগ পেলেই শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন বিদেশিরা।

শেয়ার কেনা-বেচার পরিসংখ্যান

ডিএসইর তথ্য মতে, মে মাসে ১৮ হাজার ৬৭৩ কোটি ৭০ লাখ নয় হাজার ২৭২ টাকার শেয়ার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও বন্ডের লেনদেন হয়েছে। সেখানে বিদেশিরা লেনদেন করেছেন মাত্র ১১০কোটি টাকা। অর্থাৎ দশমিক ৫৮ শতাংশ লেনদেন হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে।

শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল বিদেশিদের বিও হিসাব ছিল ৬২ হাজার ৮৯৪টি। সেখান থেকে ১২১টি কমে গত ৩১ মে দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৭৭৩টিতে।

এ বিওধারী বিদেশিদের ১১০ কোটি টাকার মধ্যে ৩৩ কোটি ছয় লাখ ৩৬ হাজার ৬৪৩ টাকার শেয়ার কেনা হয়েছে। তার বিপরীতে ৭৭ কোটি ২০ লাখ ৬৪ হাজার ৯৫৮ টাকার বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ নিট বিনিয়োগ কমেছে ৪৪ কোটি ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৩১৫ টাকা।

২০২২ সালের মে মাসে ডিএসইতে বিদেশিদের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ৩৬৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬৪ হাজার ৮৭ টাকার। এর মধ্যে ৯৬ কোটি ৪৪ লাখ ৫৬ হাজার ৮৩৫ টাকার শেয়ার কেনা আর বিক্রি হয়েছিল ২৬৯ কোটি ৩১ লাখ সাত হাজার ২৫২ টাকার শেয়ার। অর্থাৎ ২০২২ সালে মে মাসের তুলায় ২০২৩ সালের মে মাসে বিদেশিদের লেনদেন কমেছে ২৫৫ কোটি ৪৮ লাখ ৬২ হাজার ৪৮৬ টাকা।

শুধু গত বছরের তুলনায় যে কমেছে তা নয়, চলতি বছরের এপ্রিল মাসের চেয়েও মে মাসে ৭২ কোটি টাকার লেনদেন কমেছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বিদেশিদের লেনদেন হয়েছিল ১৮২ কোটি ২১ লাখ ৩১ হাজার ৫১২ টাকা। এর মধ্যে ১৩১ কোটি ৪২ লাখ ২৭ হাজার ২৪০ টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৫০ কোটি ৭৯ লাখ চার হাজার ২৭১ টাকার।

মে মাসে লেনদেন হয়েছে মাত্র ১১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশিরা ৩৩ কোটি ছয় লাখ ৩৬ হাজার ৬৪৩ টাকার শেয়ার কিনেছেন। বিপরীতে ৭৭ কোটি ২০ লাখ ৬৪ হাজার ৯৫৮ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন।

শুধু গত বছরের তুলনায় যে কমেছে তা নয়, চলতি বছরের এপ্রিল মাসের চেয়েও মে মাসে ৭২ কোটি টাকার লেনদেন কমেছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বিদেশিদের লেনদেন হয়েছিল ১৮২ কোটি ২১ লাখ ৩১ হাজার ৫১২ টাকা। এর মধ্যে ১৩১ কোটি ৪২ লাখ ২৭ হাজার ২৪০ টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি হয়েছে ৫০ কোটি ৭৯ লাখ চার হাজার ২৭১ টাকার শেয়ার

সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ার। ব্যাংকটির দশমিক ৩৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছেন বিদেশিরা। ইসলামী ব্যাংকের পাশাপাশি এ খাতের কোম্পানি ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার দশমিক ৭ শতাংশ, সিটি ব্যাংকের দশমিক ৬ শতাংশ, এনসিসি ও ইউসিবি ব্যাংকের শেয়ার দশমিক ১ শতাংশ করে বিক্রি করেছেন বিদেশিরা। তবে এ সময়েও নতুন করে ডাচ বাংলা ব্যাংকের শেয়ার ১ শতাংশ কিনেছেন তারা।

শেয়ার বিক্রির তালিকায় খাতওয়ারি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ওষুধ খাতের কোম্পানি। বিদেশিরা এ খাতের কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস-এর শেয়ার দশমিক ৮ শতাংশ বিক্রি করেছেন, রেনেটার দশমিক ১ শতাংশ এবং বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ার দশমিক ৫ শতাংশ বিক্রি করেছেন।

তবে এ সময়ে তারা নাভানা ফার্মার দশমিক ১ শতাংশ শেয়ার কিনেছেন। এর আগের মাস এপ্রিলে বিদেশিরা ওরিয়ন ফার্মা ও ওরিয়ন ইনফিউশনের দশমিক ৩ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছেন।

টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানি গ্রামীণফোনের দশমিক ৭ শতাংশ এবং বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলসের শেয়ার দশমিক ৫ শতাংশ বিক্রি করেছেন বিদেশিরা।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের শেয়ারের মধ্যে সিভিও পেট্রোক্যামিকেলের শেয়ার দশমিক ২৩ শতাংশ এবং ডেসকোর ১ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছেন বিদেশিরা। অপরদিকে ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিংয়ের দশমিক ২ শতাংশ কিনেছেন।

এছাড়া সিমেন্ট খাতের প্রিমিয়ার সিমেন্ট ও লাফার্জহোলসিমের দশমিক ১ শতাংশ এবং বস্ত্র খাতের প্রতিষ্ঠান হাওয়েল টেক্সটাইলের শেয়ার দশমিক ২ শতাংশ, তাল্লু স্পিনিংয়ের শেয়ার দশমিক ৩ শতাংশ বিক্রি করেছেন। একই সময়ে সিরামিক খাতের কোম্পানি মুন্নু সিরামিকের শেয়ার দশমিক ১ শতাংশ কিনেছেন তারা।

অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমায় বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘বাজার ভালো না থাকায় ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে আটকে রয়েছেন তারা। ফ্লোর প্রাইসের কারণে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তারা বিক্রি করতে পারছিলেন না। এখন যখন দেখলেন কিছু শেয়ার ফ্লোর প্রাইস থেকে বেরিয়ে আসছে তখনই তারা বিক্রি করে দিচ্ছেন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারের প্রতি বিদেশিদের আস্থা দিনদিন কমছে। এ কারণে তারা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, বিদেশিরা সবসময় ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে থাকেন। তাদের শেয়ারগুলো এখন ফ্লোরে আটকে আছে। ফ্লোর না থাকলে বিক্রির প্রবণতা আরও বাড়ত।

এমআই/