সুযোগ পেলেই করছে শেয়ার বিক্রি
১১ বছরের মধ্যে বিদেশিদের সর্বনিম্ন লেনদেন
দেশের পুঁজিবাজারে চলতি বছরের মার্চ মাসে বিদেশিরা মাত্র ৮৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার শেয়ার কেনা-বেচা করেছে। যা ফেব্রুয়ারি মাসের থেকে প্রায় ১০৫ কোটি টাকারও কম। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসই নয়, তার আগের মাস জানুয়ারি কিংবা এর আগের মাস ডিসেম্বরের থেকেও কম।
একইভাবে মাস ওয়ারী লেনদেনের চিত্রে দেখা গেছে বিদেশিরা ২০১২ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মার্চ মাসে সর্বনিম্ন লেনদেন করেছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বিদেশিরা। এ কারণে তারা সুযোগ পেলেই শেয়ার বিক্রি করে চলে যাচ্ছে। আস্থা সংকটের মূল কারণ হচ্ছে বাজার নিয়ে বিএসইসির অযাচিত হস্তক্ষেপ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্লোর প্রাইস আরোপ, মূল মার্কেটের থেকে কমে ব্লক মার্কেটে শেয়ার লেনদেনের সুযোগ করে দেওয়া।
বিদেশি বিনিয়োগ কমার বিষয়টি স্বীকার করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশিরা যেসব কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচা করে, সেগুলো বেশিরভাগই ফ্লোর প্রাইসের মধ্যে রয়েছে। এ কারণে তাদের লেনদেন কম হয়েছে।
তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাই শুধু নয়, সব বিনিয়োগকারীরাই যখন দেখেন মুনাফা করা সম্ভব তখনি বিনিয়োগ করে। এখন বাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম যৌক্তিমূলের থেকে কম দামে রয়েছে। তারা এখন সে সব শেয়ারে বিনিয়োগের জন্য চিন্তা করছে। শিগগিরই তারা বিনিয়োগ করবে।
বিএসইসির তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিদেশিদের মোট লেনদেন হয় ১৭৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৯ হাজার ৮৩৫ টাকার শেয়ার। এর মধ্যে ২১ কোটি টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেছে ১৩৫ কোটি টাকার শেয়ার।
তার পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে তাদের লেনদেন হয়েছে ১৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে শেয়ার কিনেছে ৮৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকার, তার বিপরীতে শেয়ার বিক্রি করেছেন ১০২ কোটি ৪৬ লাখ ৫৯ হাজার ৮৭৬ টাকা।
এর পরের মাস মার্চে লেনদেন হয়েছে মাত্র ৮৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার শেয়ার। এর মধ্যে শেয়ার কিনেছে ৪৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকার, তার বিপরীতে শেয়ার বিক্রি করেছে ৪২ কোটি ১ লাখ ৫৮ হাজার ১৫৭ টাকা। যা প্রায় ১১ বছরের মধ্য সর্বনিম্ন লেনদেন। এর আগে ২০১২ আগস্ট মাসে সর্বনিন্ম লেনদেন হয়েছিল ৬৮ কোটি টাকা। দেশের পুঁজিবাজারে এখন ৬৩ হাজার বেনিশিফিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টধারী বিদেশি বিনিয়োগকারী রয়েছে।
অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদেশিদের লেনদেন হয়েছে ১৯২ কোটি ৪৬ লাখ ২৩ হাজার ৩৬ টাকার শেয়ার। ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি লেনদেন হয়েছিল ২৯৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৮২১ টাকা।
অর্থাৎ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় ২০২৩ সালে ১০৩ কোটি ৪২ লাখ ৯৫ হাজার ৫৮৫ টাকার কম কেনা-বেচা হয়েছে। যা শতাংশের হিসেবে কমেছে ৩৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
তার পরের মাস মার্চে ২০২৩ সালে লেনদেন করেছেন মাত্র ৮৭ কোটি ৫১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭ টাকা। অথচ ২০২২ সালের মার্চ মাসে বিদেশিরা লেনদেন করেছিল ৩৮৯ কোটি ২৬ লাখ ১০ হাজার ৬৭২ টাকা। ৩০১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা কম লেনদেন হয়েছে। যা শতাংশের হিসেবে আগের বছরের চেয়ে ৭৭ দশমিক ৫২ শতাংশ কম।
অর্থনীবিদরা বলছেন, মার্কিন (ইউএস) ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। অর্থাৎ ডলার বাজারের সংকট বা অস্থিরতা কাটছে না। তার ওপরে বাজারে আরোপ করা হয়েছে ফ্লোর প্রাইস। এর ফলে ভালো কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচা করতে পারছে না। তবে সুযোগ পেয়ে এখন ব্লক মার্কেটে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে।
এছাড়াও পুঁজিবাজারে সুশান ও ভালো কোম্পানির অভাবে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বাজার ছাড়ছে বিদেশিরা। ফলে মার্চ মাসে বিদেশিদের ১১৭টি বিও অ্যাকাউন্ট কমেছে।
শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, ২৮ ফেব্রুয়ারিতে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টধারীর বিনিয়োগকারী সংখ্যা ছিল ৬৩ হাজার ১২৫টি। সেখান থেকে ১১৭টি কমে ৩১ মার্চ মাসে দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ৮টিতে।
এ বিষয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতির রিচার্ড ডি রোজারিও পোস্টকে বলেন, ডলারের বাজারে অস্থিরতার কারণে নতুন করে বিনিয়োগ থেকে বিরত রয়েছে অধিকাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারী। পাশাপাশি ফ্লোর প্রাইসের কারণে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও নিজেদের শেয়ার বিক্রি করতে পারছে না বিদেশিরা। এ কারণে সুযোগ পেলেই শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে তারা।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত এক দেড় বছর ধরে যেভাবে চলছে দেশের পুঁজিবাজার, সেইভাবে কী একটি দেশের পুঁজিবাজার চলতে পারে? বিদেশিরা কেন দেশি বড় বড় বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ কিংবা ডলারে বাজারে অস্থিরতার চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, বাজার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অযাচিত হস্তক্ষেপ। এ হস্তক্ষেপের কারণে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। এ কারণে বাজারে লেনদেন কমছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশিরা সবসময় ভালো মৌলভিক্তি সম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে থাকে। তাদের শেয়ারগুলো এখন ফ্লোরে আটকে আছে। ফ্লোর না থাকলে বিক্রির প্রবণতা আরও বাড়ত।
তিনি বলেন, বিদেশিরা এখন শেয়ার বিক্রির মানসিকতায় রয়েছে। কিন্তু ফ্লোরে থাকায় তারা বিক্রি করতে পারছে না। যখনই সুযোগ পাচ্ছে বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
এমআই/এফকে