শাস্তি পেলেন অ্যাপোলো ইস্পাতের এমডি-পরিচালকরা
চার বছর ধরে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়নি, উৎপাদন বন্ধ এমনকি ঋণে জর্জরিত কোম্পানির নাম অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স লিমিটেড। এখানেই শেষ নয়, গত চার বছর ধরে কোম্পানির অবস্থা কী- তা বিনিয়োগকারী তো দূরের কথা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও স্টক এক্সচেঞ্জকেও জানায়নি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।
যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ২২ এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইন ভাঙার কারণে কোম্পানির পরিচালক ইভানা ফাহমিদা মাহমুদ, রোকসানা বেগম, এম এ মাজেদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুলকে বড় শাস্তির আওতায় এনেছে বিএসইসি। তাদের সবাইকে এক লাখ টাকা করে মোট ৪ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোম্পানির পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনেক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কোম্পানির তিন পরিচালক ও এমডিকে এক বছর ৯ মাসের আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার কারণে চার লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত এক বছর এবং ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত মোট ৯ মাসের তিন প্রান্তিকের প্রতিবেদন জমা দেয়নি অ্যাপোলো ইস্পাত।
নিয়ম থাকলেও আর্থিক প্রতিবেদন কমিশন ও স্টক এক্সচেঞ্জে জমা না দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন কোম্পানি সচিব এসকে আবুল হাসান। তিনি বলেন, করোনায় ম্যানেজমেন্ট ক্রাইসিস ছিল, লোকবলের অভাব ছিল। এ কারণে আর্থিক প্রতিবেদন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়; কিন্তু কমিশনে জমা দেওয়া হয়নি। কারণ আমাদের চেয়ারম্যান দীন মোহাম্মদ মারা যাওয়ায় তার স্বাক্ষর নেওয়া সম্ভব হয়নি।
>> বিমার টাকা দিচ্ছে না সানলাইফ, চেয়ারম্যান-এমডির বিরুদ্ধে পরোয়ানা
নিয়ম অনুসারে, এক বছরের আর্থিক প্রতিবেদন বছর শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জ, বিএসইসি ও গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে হয়। আর প্রতি প্রান্তিক অর্থাৎ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিক শেষ হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করতে হয়। কোম্পানি এসব নিয়মও ভঙ্গ করেছে।
বিএসইসির বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদন দেখা যায়, অ্যাপোলো ইস্পাত ২০২০ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ রুলস, ২০২০ এর রুলস ১৪ (৪) মোতাবেক প্রস্তুতপূর্বক সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন, স্টক এক্সচেঞ্জ ও শেয়ারহোল্ডারদের নিকট দাখিল করতে বাধ্য যা পরিপালনে উক্ত ইস্যুয়ার ব্যর্থ হয়েছে।
এছাড়াও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ২সিসি এর অধীনে জারিকৃত সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশনের নোটিফিকেশন নং- বিএসইসি/সিএমআরআরসিডি/২০০৬-১৫৮/২০৮/এডমিন/৮১ তারিখ ২০ জুন ২০১৮ এর ৪(১), ৪(২) এবং ৪(৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখিত শর্তানুসারে অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স ২০২০ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ও একই বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এবং ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চে সমাপ্ত ত্রৈমাসিক হিসাব বিবরণী প্রস্তুতপূর্বক সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন ও স্টক এক্সচেঞ্জে দাখিল করতে বাধ্য। যা পরিপালনে অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স লিমিটেড ইস্যুয়ার ব্যর্থ হয়েছে।
ইস্যুয়ার কর্তৃক আর্থিক প্রতিবেদন দাখিলে ব্যর্থতার জন্য কমিশন কর্তৃক গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ইস্যুয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্য পরিচালক ও কোম্পানি সচিবকে নির্ধারিত তারিখে উক্ত ব্যর্থতার কারণ প্রদর্শনসহ শুনানিতে উপস্থিত হতে বলা হয়। পরে কোম্পানি সচিব এসকে আবুল হাসান ও অ্যাসিস্ট্যান্ট কোম্পানি সচিব মাহমুদুর রহমান ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি শুনানিতে উপস্থিত হন। তারা শুনানিতে প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি।
বিএসইসির প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাপোলো ইস্পাতের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, উপস্থাপিত অভিযোগগুলো সঠিক। এ ক্ষেত্রে অ্যাপোলো ইস্পাতের ব্যাখ্যা কমিশনের নিকট গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি। এটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার এর পরিচালকমন্ডলীর সদস্য ও প্রতিনিধিরা সিকিউরিটিজ সংক্রান্ত আইন ও বিধিবিধান পরিপালনের ব্যর্থতার জন্য দায়ী।
যেহেতু ইস্যুয়ার কোম্পানিতে জনসাধারণের মালিকানার শেয়ার রয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরেও ইস্যুয়ার কর্তৃক হিসাব বিবরণী দাখিল না করায় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে ও হচ্ছে। যা পুঁজিবাজারের উন্নয়নের পরিপন্থী। ইস্যুয়ার কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষাসহ পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা কমিশনের অন্যতম উদ্দেশ্য ও কর্তব্য।
>> পুঁজিবাজার থেকে ১০৬ কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত সরকার
কমিশনের বিবেচনায়, সিকিউরিটিজ আইন ও বিধি-বিধান পরিচালনের উল্লেখিত ব্যর্থতার জন্য, পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জনস্বার্থে আলোচ্য ইস্যুয়ারের পরিচালকদের প্রত্যেককে জরিমানা করা প্রয়োজন ও সমীচীন।
অতএব কমিশন উল্লিখিত যাবতীয় বিষয় বিবেচনাপূর্বক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অডিন্যান্স, ১৯৬৯ (অডিন্যান্স নং, এক্সভিআইআই অব ১৯৬৯) এর সেকশন ২২ (যা দ্যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ (এমেনমেন্ট) একশন, ২০০ দ্বারা সংশোধিত এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কোম্পানির পরিচালক ইভানা ফাহমিদা মাহমুদকে ১ লাখ, রোকসানা বেগমকে ১ লাখ, এম এ মাজেদকে ১ লাখ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুলকে ১ লাখ টাকা করে মোট চারজনকে ৪ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।
যা অত্র আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে বিএসইসির অনুকূলে ইস্যুকৃত ব্যাংক ড্রাফট/পে অর্ডারের মাধ্যমে কমিশনে জমা করতে বলা হলো।
২০১৮ সালের ৩০ জুন কোম্পানির সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, কোম্পানির ব্যাংক ঋণ রয়েছে ৩০৬ কোটি ৫০ লাখ ৮০ হাজার টাকার। এর মধ্যে স্বল্প মেয়াদি ঋণ রয়েছে ২৩৫ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ রয়েছে ৭০ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৭২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ঋণে জর্জরিত কোম্পানির এই অবস্থা দেখে কোম্পানির শেয়ারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে ২০২২ সালে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে কোম্পানির শেয়ারের কোনো ক্রেতা নেই। তাই কোনো শেয়ার লেনদেন হয়নি। কোম্পানির শেয়ার ২০২২ সালে ৪ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ ৮ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হয়েছিল।
২০১৩ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ৪০ কোটি ১৩ লাখ ৮ হাজার ৬০০ শেয়ার রয়েছে। প্রকৌশল খাতের এই কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার ৫ বছর পর থেকে আর কোনো লভ্যাংশের মুখ দেখেনি। অর্থাৎ ৩০ জুন ২০১৮ সমাপ্ত বছরের ৩ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছিল।
তারপর থেকে ২০১৯, ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ মোট চার বছর ধরে লভ্যাংশ দেয়নি। অদূর ভবিষ্যতে কোম্পানির অবস্থা ভালো হবে বা হারানো শেয়ারের দাম বাড়বে কিংবা ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে এমন কোনো সম্ভাবনাও দেখছে না।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, তালিকাভুক্তির সময়ই বলেছিলাম এই কোম্পানির অবস্থা ভালো নেই। কোম্পানিকে যেন প্রিমিয়াম নিয়ে বাজারে আসতে না দেওয়া হয়। আমার কথা ঠিক হলো। এটার দায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নিতে হবে। কীভাবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ করা যায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এমআই/ওএফ