বারবার নির্দেশ দেওয়ার পরও বিনিয়োগকারীদের অবণ্টিত ও লভ্যাংশের অর্থ পুঁজিবাজার স্থিতিশীল তহবিল বা ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে (সিএমএসএফ) জমা দেয়নি বেশ কয়েকটি কোম্পানি। পাশাপাশি অবণ্টিত অর্থ বিতরণে কারসাজি করার অভিযোগ রয়েছে বেশ কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে চারটি অডিটর নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

গত রোববার (০৫ ফেব্রুয়ারি) এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ সংক্রান্ত একটি চিঠি সিএমএসএফের চিফ অব অপারেশনের (সিওও) কাছে পাঠানো হয়েছে।

সেই চিঠি আজ বুধবার (০৮ ফেব্রুয়ারি) পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যার অনুলিপি ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এবং সিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককেও (এমডি) দেওয়া হয়েছে।

বিএসইসির সহকারী পরিচালক মিনহাজ বিন সেলিমের সই করা চিঠিতে বলা হয়, সিএমএসএফের সহযোগিতায় কমিশন যেসব কোম্পানি দাবিদারহীন বিনিয়োগকারীদের অবণ্টিত অর্থ জমা এখনো ফান্ডে জমা দেয়নি, সেসব কোম্পানিতে অডিটর নিয়োগ করা হবে।

এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর অতীত ইতিহাস যেমন-ঋণ খেলাপী কী না, নন-কমপ্লায়েন্স ও ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানি কী না তা দেখে কমিশন অডিটর নিয়োগ করা হবে। চারটি অডিটর কোম্পানিকে বাছাই ও নিয়োগ করবে বিএসইসি। অডিটরের সমস্ত ব্যয় বহন করবে সিএমএফএস ফান্ড। অডিট কমিটিকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে সিএমএসএফ কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে সিএমএসএফের সিওও মনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিনিয়োগকারীদের অবণ্টিত ও দাবিহীন লভ্যাংশ সিএমএফসএফের তহবিলে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরও এখনও বেশকিছু কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের নগদ ও বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ জমা দেয়নি। এই কোম্পানিগুলো এখনো কেন বিনিয়োগকারীদের অবণ্টিত ও দাবিহীন লভ্যাংশ জমা দেয়নি। এছাড়াও যেসব কোম্পানি বলছে বিনিয়োগকারীদের অর্থ দিয়ে দিয়েছে, তারা সঠিকভাবে দিয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে অডিটর নিয়োগ দিয়েছে কমিশন।

তিনি বলেন, সব কোম্পানি এই ফান্ডে বিনিয়োগকারীদের অর্থ জমা দিলে ফান্ডের আকার আরও বাড়বে। অডিটর অডিট করার পর প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর সময় পর্যন্ত পুঁজিবাজার স্থিতিশীল তহবিল বা ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) আকার দাঁড়িয়েছে ১১২১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে নগদ অর্থ দাঁড়িয়েছে ৪৮৯ কোটি ১ লাখ টাকায়। আর ৮ কোটি ১২ লাখ শেয়ার বাবদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

সিএমএসএফ সূত্র মতে, ১১শ কোটি টাকার ফান্ডের মধ্যে ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা দাবি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। ২২৫ কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে গোল্ডেন জুবিলি ফান্ডে।

সব মিলিয়ে ২৭৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যবহার করা হয়েছে। এখনও ৮৪৫ কোটি ১০ লাখ টাকা অব্যবহৃত রয়েছে। এর মধ্যে কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রয়েছে ২১২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর কোম্পানিতে ৬৩২ কোটি ৪২ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে।

অবণ্টিত ও দাবিহীন লভ্যাংশ কী?

কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ ঘোষণার পর তা তাদের ডিভিডেন্ড অ্যাকাউন্ট থেকে বিনিয়োগকারীদের নামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নগদ লভ্যাংশ সরাসরি বিনিয়োগকারীদের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। স্টক লভ্যাংশ জমা হয় তাদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টে।

যাদের নামে শেয়ার তারা কেউ মারা গেলে, বিদেশে চলে গেলে কিংবা দীর্ঘদিন খোঁজ না রাখলে তাদের ব্যাংক হিসাব বন্ধ বা অকার্যকর হয়ে যায়। বিও হিসাবের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। এমন ক্ষেত্রে লভ্যাংশের টাকা বা শেয়ার বিনিয়োগকারীর ব্যাংক বা বিও অ্যাকাউন্টে জমা না হয়ে কোম্পানির কাছে ফেরত যায়।

বিনিয়োগকারীর মৃত্যুর পর অনেক সময় তথ্য বা কাগজপত্রের অভাবে তার মনোনীত উত্তরাধিকারও সেই টাকা বা শেয়ার আর দাবি করেন না। এর বাইরেও আইনি জটিলতা বা অন্য কারণে লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীর হাতে পৌঁছায় না অনেক সময়। তখন কোম্পানি ওই সব লভ্যাংশ ‘সাসপেন্ডেড’ হিসাবে জমা দেখিয়ে চূড়ান্ত আর্থিক বিবরণী তৈরি করে। সিডিবিএলের হিসাবে, ফান্ড তৈরির সময় সাসপেন্ডেড বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩১৫টি। এখন সেই সংখ্যা কমে এসেছে।

প্রথম দিকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ধারণা ছিল- ফান্ডের আকার হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সেটা হয়নি। তারপর প্রত্যাশা করা হয় তহবিলের আকার হবে ৫ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়নি। বর্তমানে ফান্ডটির পরিমাণ ১১২১ কোটি টাকা। ব্যাংকসহ যেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও নগদ অর্থ বাকি রয়েছে এগুলো জমা হলে ২ হাজার কোটি টাকা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই তহবিলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান। এছাড়া পরিচালনা পর্ষদে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক তানজিলা দিপ্তী, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আমিন ভুঁইয়া, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ফজল বুলবুল, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সিসিবিএলের স্বতন্ত্র পরিচালক মোহাম্মদ তারেক এবং এ কে এম দেলোয়ার হোসেন রয়েছেন।

নিয়ম অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শেয়ারে এই তহবিলের ৪০ শতাংশ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। ৫০ শতাংশ অর্থে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ দেওয়া হবে। আর ১০ শতাংশ অর্থ অতালিকাভুক্ত কোম্পানি বা সরকারি সিকিউরিটিজ, স্থায়ী আমানত ও বে-মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা যাবে।

এমআই/কেএ