২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে তিনগুণ মুনাফা করেছে পুঁজিবাজারে প্রকৌশল খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আনোয়ার গ্যালভানাইজিং লিমিটেড। এ অবস্থায় কোম্পানিটি শেয়ার-হোল্ডারদের জন্য ১০০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। গত ২৭ অক্টোবর ঘোষিত এ লভ্যাংশের মধ্যে ২০ শতাংশ নগদ এবং ৮০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ। 

তবে বিপত্তি দেখা দিয়েছে এর লভ্যাংশ ঘোষণার প্রক্রিয়ায়। পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা আইন মেনে লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। এর ফলে নিয়মের বাইরে যে পরিমাণ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে তার বিপরীতে তাদের ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। এছাড়া ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের বাজার মূলধন ৩০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে বলেছে বিএসইসি।

এই দুই প্রেক্ষাপটে পড়ে এখন আনোয়ার গ্যালভানাইজিং কোম্পানি বলছে তারা বেশি লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের দিতে পারবে না। যেহেতু তাদের মুনাফার টাকা বাজার মূলধন বৃদ্ধিতে এবং কর দিতে চলে যাবে।

নিয়ম অনুযায়ী নগদ ও বোনাসের লভ্যাংশ সমান হতে হবে। কিন্তু ২০ শতাংশ নগদের বিপরীতে ৮০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছে কোম্পানিটি। এতে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে।

এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। ১০০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণায় তারা যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। এখন তারা চরমভাবে আশাহত। নতুন অনেকে যারা বিনিয়োগ করেছেন তারা আতংকে আছেন, কারণ এখন এই কোম্পানির শেয়ারের দর কমে যেতে পারে।

ডিএসইর তথ্য মতে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের কর পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ১৯ কোটি ৩৫ লাখ ৩২ হাজার ৭২৪ টাকা। তাতে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ৫৪ পয়সা। ২০২১ সালে ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৯২ পয়সা। 

জানা গেছে, বর্তমানে কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা ১ কোটি ৬৭ লাখ ৭০ হাজার ৬০০টি। ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণার ফলে বিনিয়োগকারীদের জন্য নির্ধারিত লভ্যাংশের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৪১ হাজার ২০০ টাকা। এরপরও বিগত অর্থবছরে কোম্পানিটির মুনাফার অর্থ অবশিষ্ট থাকে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার শর্ত পূরণ করতে গিয়ে বিনিয়োগকারীদের বেশি মুনাফা দিতে পারছে না কোম্পানিটি। ফলে বড় অংকের মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

ভালো মুনাফার আশায় গত ১৮ অক্টোবর কোম্পানিটির ১০ হাজার শেয়ার কেনেন এসএআর সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী রুপক চক্রবর্তী। তিনি বলেন, শেয়ার কেনার পর দেখলাম ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশের তুলনায় চারগুণ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানি। এরপর থেকে শেয়ারের দাম কমেছে। শেয়ার কিনে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

একই কথা বলেন আইপিডিসি সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী আশিকুজ্জামান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি শুনেছিলাম কোম্পানিটি ৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেবে, কিন্তু দিয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। এখন দেখি এজিএমে কী সিদ্ধান্ত হয়, সেদিন যদি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা যায় তাহলে ভালো হয়। 

১৯ কোটি টাকা মুনাফার পরও বিনিয়োগকারীরা কাঙ্ক্ষিত লভ্যাংশের টাকা না পাওয়ার বিষয়ে কোম্পানি সচিব তাওহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কোম্পানির বাজার মূলধন ৩০ কোটি টাকায় উন্নীত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা যাবে জরিমানা (কর) পরিশোধে। যা মুনাফা থেকে সমন্বয় করা হবে। যে কারণে ভালো মুনাফার পরও বিনিয়োগকারীদের বেশি নগদ লভ্যাংশ দিতে পারছি না।

সচিব তাওহিদুল ইসলাম জানান, কোম্পানি আইন অনুসারে লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদনের বিষয় আছে। সেটি করার জন্য আগামী ১৭ জানুয়ারি কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএ) দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই দিন শেয়ারহোল্ডাররা ইচ্ছে করলে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারবেন।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কী কারণে কোম্পানিটি এত পরিমাণে বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিচ্ছে তা বিএসইসিকে খতিয়ে দেখা উচিত। যৌক্তিক কারণ না থাকলে বোনাস শেয়ারের প্রস্তাব বাতিল করা উচিত।

জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী নগদ ও বোনাসের লভ্যাংশ সমান হতে হবে। কিন্তু ২০ শতাংশ নগদের বিপরীতে ৮০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছে কোম্পানিটি। এতে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে।

তিনি বলেন, কোম্পানি আইন অনুসারে আনোয়ার গ্যালভানাইজিং পরিচালনা পর্ষদ সভায় লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন এজিএমে পাস হলে এই প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কমিশনে আবেদন করবে। কোম্পানি যদি যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারে তবে বিএসইসি প্রস্তাব বিবেচনা করবে। যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারলে বোনাস লভ্যাংশের বিষয়টি কমিশন বাতিল করতে পারে।

কেন জরিমানা

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে অন্তত অর্ধেক বোনাস ও অর্ধেক নগদ দেওয়ার বিধান রয়েছে। আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদ সেই আইন ভঙ্গ করে ১০০ শতাংশের মধ্যে ২০ শতাংশ নগদ আর ৮০ শতাংশ (১৩ কোটি ৪২ লাখ টাকার শেয়ার) বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে।

অর্থাৎ নগদের চেয়ে চারগুণ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ফলে শাস্তি হিসেবে কোম্পানিকে বোনাস শেয়ারের ওপর ১০ শতাংশ হারে ট্যাক্স দিতে হবে। অর্থাৎ ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে। যা কোম্পানিটির ৮ শতাংশ নগদ লভ্যাংশের সমান।

আয়কর অধ্যাদেশে নতুন ধারা সংযোজন

অর্থ আইন, ২০১৯ এর মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন ধারা (১৬ নম্বর) সংযোজন করা হয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানিকে স্টক ডিভিডেন্ডের কমপক্ষে সমপরিমাণ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিতে হবে। যদি স্টক ডিভিডেন্ড দেওয়ার পরিমাণ ক্যাশ ডিভিডেন্ডের চেয়ে বেশি হয় তাহলে যে পরিমাণ স্টক ডেভিডেন্ড দেওয়া হবে বা হয়েছে তার পুরোটার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। এ কর কোম্পানিকে সংশ্লিষ্ট কর বছরের আয়কর রিটার্ন দাখিলের আগে পরিশোধ করতে হবে। এটি অন্য কোনো করের সঙ্গে সমন্বয় করা যাবে না।
 
এমআই/জেডএস