প্রগ্রেসিভ লাইফের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে কমিটি
বছরের পর বছর অবৈধ ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও লাইসেন্সবিহীন এজেন্টকে কমিশন দিয়েছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত বিমা খাতের প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানিটি অনুমোদন ছাড়া শাখা খুলে ব্যবসা করছে, অনৈতিকভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাতা প্রদান ও প্রশিক্ষণের নামে ব্যয় বেশি দেখাচ্ছে। এছাড়া মেয়াদ পূর্তি হওয়ার পরও গ্রাহকের বিমা দাবি দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি।
এসব অনিয়মের পাশাপাশি সর্বশেষ গত ১০ বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের কারসাজি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বিজ্ঞাপন
ফারইস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্সের মতোই প্রগ্রেসিভ লাইফেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অসংখ্য গ্রাহক। পাশাপাশি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধ করছে না। গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন : জুয়াড়িদের দখলে পুঁজিবাজার, নিষ্ক্রিয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা
তদন্ত কমিটি কোম্পানির গত ১০ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখবে। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য ব্যয়, কোম্পানির অর্থ কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে, বিমার মেয়াদপূর্তির পরও কেন গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করছে না; এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হবে।
২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৪০ শতাংশ বিমা দাবি পূরণ করেনি কোম্পানিটি। এর মধ্যে মৃত্যু বিমার দাবি রয়েছে ৩০ শতাংশ। ২০০০ সালে দেশের বিমা খাতের যাত্রা শুরু করা প্রগ্রেসিভ লাইফ ২০০৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৩ সালে কোম্পানির লাইফ ফান্ড ছিল ৩৮২ কোটি টাকা। সেখান থেকে ১৩২ কোটি টাকা কমে ২০২১ সালে দাঁড়ায় ২৫০ কোটি টাকা। দিনদিন লাইফ ফান্ড কমছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে যদি অনিয়ম প্রমাণিত হয়, তবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে কোম্পানির চেয়ারম্যান নাসির আলী শাহ, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা(সিইও) অজিত চন্দ্র আইস এবং কোম্পানি সচিব জহির উদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।
এদিকে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্সের ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) নিরীক্ষা ফার্ম মেসার্স একনাবিনকে দিয়ে বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। ফার্মটি নিরীক্ষা শেষে ২১টি বিষয়ে অনিয়ম দেখতে পায়। সর্বশেষ ত্রি-পক্ষীয় শুনানি শেষে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় মুখ্য নির্বাহীসহ প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করেছে আইডিআরএ।
আরও পড়ুন : মৃত্যুর ২৮ বছর পর শেয়ারের অর্থ পাচ্ছেন জাহানারা ইমাম
বিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, বিমা কোম্পানিগুলোর অনিয়ম দিনদিন বেড়ে চলছে। বিমা আইনে যে শাস্তির বিধান রয়েছে সেগুলোর পরিবর্তন করতে হবে। কোম্পানিগুলো যাতে অনিয়ম করতে ভয় পায় সে ধরনের আইন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে বিমা খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে যাবে।
এ বিষয়ে আইডিআরএ’র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শাকিল আখতার বলেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয়সহ কোম্পানির সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করতে বিমা আইন ২০১০ এর ২৯ ধারা মোতাবেক বিশেষ নিরীক্ষার জন্য মেসার্স একনাবিনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফার্মের দেওয়া নিরীক্ষায় ২১টি বিষয় পর্যবেক্ষণ করে পাঁচটি বিষয়ে অনিয়মের জন্য কোম্পানিকে ১৯ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া বেশকিছু বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
‘কমিশন ও ভাতা’য় অনিয়ম
কোম্পানিটি আইডিআরএ বিধি লঙ্ঘন করে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিন বছরে কমিশন ও উন্নয়ন ভাতা, মোবাইল ব্যয় এবং প্রণোদনা বাবদ নগদ অর্থ দিয়েছে। নিয়ম অনুসারে এগুলো অ্যাকাউন্টপেয়ি চেকের মাধ্যমে করতে হয়। শুধু তা-ই নয়, লাইসেন্সবিহীন এজেন্টকে কোম্পানিটি এজেন্ট কমিশনও দিয়েছে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে বিমা আইন লঙ্ঘন হয়েছে।
নগদ কমিশন বা ভাতা নিয়ে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জারি করা আইডিআরএ প্রজ্ঞাপন লঙ্ঘন করেছে প্রগ্রেসিভ লাইফ। এজন্য বিমা আইন ২০১০ এর ১৩০ ধারা অনুসারে কোম্পানিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
বিষয়টি স্বীকার করে প্রগ্রেসিভ লাইফ বলেছে, প্রগ্রেসিভ লাইফের উন্নয়ন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কমিশন দেওয়া, রিলিজ, ইনসেন্টিভ বোনাস, উন্নয়ন বিভাগের বেতন-ভাতা অ্যাকাউন্টপেয়ি চেকের মাধ্যমে দেওয়া হবে। এছাড়া প্রগ্রেসিভ লাইফ আইডিআরএ’র সার্কুলার মেনে চলবে।
আরও পড়ুন : পুঁজিবাজারে আসছে ১৩ কোম্পানি, তুলবে ১২শ কোটি টাকা
লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তিকে কমিশন দিয়ে বিমা আইন ২০১০ এর ৫৮ ধারা লঙ্ঘন করেছে প্রগ্রেসিভ লাইফ। এজন্য ২০১৫-১৭ সাল পর্যন্ত সময়ের সিইওকে বিমা আইন ২০১০ সালের ১৩৪ ধারা অনুসারে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পাশাপাশি এ অপরাধ এখনও অব্যাহত থাকায় কোম্পানির সিইওকে ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালের জন্য আরও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে কোম্পানি বলছে, লাইসেন্সবিহীন এজেন্টদের ফাইল নবায়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
প্রশিক্ষণ ব্যয়
নিরীক্ষা ফার্ম মেসার্স একনাবিন বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘অ্যাপ্রুভড বাই’ ও ‘পোস্টেড বাই’ এর স্বাক্ষরের স্থান শূন্য ছিল। আর্থিক বিবরণীতে প্রশিক্ষণ ব্যয় ও ভাতা ট্রায়াল ব্যালেন্সের তুলনায় কম দেখানো হয়েছে। এ অনিয়মের কারণে কোম্পানির তৎকালীন সিএফওকে বিমা আইন ২০১০ এর ১৩৪ ধারা অনুসারে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একই সঙ্গে যথাসময়ে স্বাক্ষর ও হিসাব রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কোম্পানির বক্তব্য হলো, প্রশিক্ষণ ব্যয় বার্ষিক আর্থিক বিবরণীতে ট্রায়াল ব্যালেন্সের সঙ্গে মিল রয়েছে। এটি একনাবিনের স্পেশাল অডিট টিম ও প্রগ্রেসিভ লাইফের ম্যানেজমেন্টের মধ্যে চার্টার্ড অব অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত ধারণাগত পার্থক্য।
প্রশাসনিক খরচ
আইডিআরএ’র নিয়ম অনুসারে বিমা কোম্পানির কোনো শাখা, সার্ভিস কিংবা এজেন্সি অফিস খোলার আগে আইডিআরএ’র অনুমোদন নিতে হয়। প্রগ্রেসিভ লাইফ আইডিআরএ’র অনুমোদন ছাড়াই শাখা অফিস খুলে ব্যবসা পরিচালনা করছে। যা বিমা আইন ২০১০ এর ১৪ (১) এর লঙ্ঘন।
বিষয়টি স্বীকার করেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, ১৫০টি শাখা অফিসের অনুমোদনের জন্য আইডিআরএ’র কাছে আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তবে ফাইলগুলো হারিয়ে গেছে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুসারে ফাইলগুলো আবার জমা দেওয়া হয়েছে।
বিমা আইন ২০১০ এর ১৪ (১) ধারা লঙ্ঘনের দায়ে কোম্পানিকে পাঁচ লাখ এবং ১৩৪ ধারা অনুসারে কোম্পানির তৎকালীন মুখ্য নির্বাহীকে প্রতি বছরের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছে আইডিআরএ। একই সঙ্গে শাখা অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত কোম্পানির নাম ব্যবহার করে সাইনবোর্ড টানিয়ে কোনো অফিস খোলা যাবে না। যেসব জায়গায় সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে তার অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। এ নির্দেশনার পরও অনিয়ম করলে কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
একনাবিনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রগ্রেসিভ লাইফের দুজন কর্মচারীকে অস্বাভাবিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোম্পানি বলছে, নিয়ম মেনেই ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছে। আইডিআরএ তাদের বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে।
অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়
কোম্পানির তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে কোম্পানিটি নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত আট কোটি টাকা ব্যবস্থাপনা ব্যয় দেখিয়েছে। এর আগের বছরগুলোতে তা আরও বেশি দেখানো হয়। যা বিমা আইনের লঙ্ঘন। ২০১৫ থেকে ২০১৭, এ তিন বছর কোম্পানি অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের মাধ্যমে বিমা আইন ২০১০ এর ১৪ (২) ও ১৯৫৮ সালের বিধি ৩৯-এর লঙ্ঘন করেছে। এ কারণে বিমা আইনের ১৩০ ধারায় কোম্পানিটিকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ব্যবসা উন্নয়ন ও ভ্রমণ খরচ
ব্যবসা উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থ সম্পূর্ণ নগদ প্রদান করা হয়েছিল যা আইডিআরএ’র নিয়মের লঙ্ঘন। কোম্পানি বলছে, প্রগ্রেসিভ লাইফের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য এ অর্থ খরচ হয়েছে। ভবিষ্যতে নিয়ম মেনে চলা হবে।
কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে ৫৩ লাখ পাঁচ হাজার ৪১২ টাকার ভ্রমণ খরচ দেখানো হয়েছে। কিন্তু ট্রায়েল ব্যাল্যান্সে দেখানো হয়েছে, এক কোটি ৬৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৯ টাকা। এছাড়া টিএ-ডিএ ভাতা নগদ দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ শিটে ভাতা গ্রহণকারীর স্বাক্ষর নেই।
ব্যবসা উন্নয়ন ও ভ্রমণ ব্যয় দুটোতে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আইডিআরএ’র নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। চেকের পরিবর্তে নগদে টাকা দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এ নিয়ম মেনে চলা হয় সেজন্য সতর্ক করা হয়েছে।
এমআই/এসকেডি