দেশের অর্থনীতির তুলনায় পুঁজিবাজার এখনো পিছিয়ে। এখাতের নাম শুনলেই মানুষ ভয় পায়। আর সম্ভাবনাময় এখাতের বিকাশে প্রধান বাধা মুদ্রাবাজারে (ব্যাংক) সুশাসনের অভাব। ব্যাংক থেকে টাকা নিলে ফেরত না দিয়ে পার পাওয়া যায়। ফলে উদ্যোক্তারা পুঁজির জন্য এখানে আসতে চান না। বক্তাদের মতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে আরও সমন্বয় জরুরি।

শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে পুঁজিবাজার বিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথা বলেন।

ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) যৌথভাবে বৈঠকের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পুঁজিবাজার স্থিতিশীল তহবিলের চেয়ারম্যান ও সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সদস্য জাহিদ হাসান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. এজাজুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ, ড. হেলাল উদ্দিন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) 
চেয়ারম্যান ইউনূসুর রহমান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, আইসিএবি কাউন্সিল সদস্য গোপাল চন্দ্র ঘোষ, এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ড. হাসান ইমাম এবং ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও।

সিএমজেএফের সভাপতি জিয়াউর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন বিএমবিএ’র সভাপতি ছায়েদুর রহমান।

বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, অনেক কিছু বইয়ে লেখা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন কঠিন। এ সময়ে তিনি জানান, আগামী এক বছরের মধ্যে বাজারে কিছু ভালো কোম্পানি আসবে। এছাড়া পরিচালনায় গতি আনতে সরকারি কোম্পানির পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ে বিশ্লেষকরা উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু ওই দেশে ঋণ ও সঞ্চয়ের সুদ হার ১ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে। জাপানে কেউ ব্যাংকে টাকা রাখলে, তার অর্থ কেটে রাখা হয়। ঋণ নিলে সুদ দশমিক ৫ থেকে ১ শতাংশ। সেখানে মানুষ ভালো লভ্যাংশ পাওয়ার আসায় পুঁজিবাজারে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে অবস্থা উল্টো। এখানে আমানতের সুদ ৭ শতাংশের কাছে। ঋণের সুদ ৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতিও ৬ শতাংশের কাছে। ফলে মানুষ পুঁজিবাজারে যেতে চায় না।

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ভারতে ৪০ কোম্পানির শেয়ারের দাম ফেসভ্যালুর নিচে। কিন্তু আপনারা বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখেন, কয়টা কোম্পানি বন্ধ হচ্ছে, কয়টা কোম্পানি মার্কেট থেকে বিদায় নিয়েছে। তিনি বলেন, সমালোচনা করতে হবে ভালোর জন্য। কিন্তু তার আগে বাস্তবতা বুঝতে হবে। 

তিনি বলেন, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, তখন একভাবে চিন্তা করতাম। আর যখন মাঠে এসেছি, দেখছি, বইয়ে লেখা নিয়মকানুন সব জায়গায় পালন করা যায় না। বাস্তবতার নিরিখে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমি অনেক কিছুই চাই করতে। কিন্তু সম্ভব নয়। কারণ অনেক কিছুই প্রস্তুত না।

শিবলী রুবাইয়াত বলেন, সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্তি নিয়ে কথা আসছে। অর্থমন্ত্রী চাইছেন কোম্পানি বাজারে আনতে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর বোর্ড চায় না। তার মতে, পরিচালনায় গতিশীলতা আনতে এসব কোম্পানির বোর্ড ভেঙে দেওয়া উচিত। আমরা নতুন পণ্য চালু করতে চাই। কিন্তু দক্ষ লোকের খুবই অভাব। তবে তিনি বলেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রস্তুত থাকলে এই মাসেই সরকারি সিকিউরিটিজ চালু হবে। এর ফলে বাজার মূলধন জিডিপির ২৫ শতাংশে চলে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর যেভাবে সহযোগিতা করছে, তাতে কিছু দিনের মধ্যেই আমরা বন্ড মার্কেট শক্তিশালী দেখবো।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, দেশের পুঁজিবাজার ভালোভাবে কাজ করছে না। কারণ শিল্পায়নে ৯০ শতাংশ পুঁজি ব্যাংক থেকে আসে। ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করছে। এরপর ঋণ খেলাপি বাড়ছে। সেই ঋণ আবার অবলোপন হচ্ছে। ফলে পুঁজিবাজারের বিকাশে ব্যাংকে সুশাসন জরুরি।

তিনি বলেন, আরেকটি সমস্যা হলো এখানে ভালো কোম্পানি কম। এই কোম্পানি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকে প্রণোদনা বাড়ানোর কথা বলছেন। এরমধ্যে তালিকাভুক্ত ও বহির্ভুত কোম্পানির করের পার্থক্য বাড়ানো অন্যতম। কিন্তু পার্থক্য বাড়ালেও কোম্পানি আসবে না। মূল কথা বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে আইন বাস্তবায়নের সক্ষমতা কম। এই সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন বলেন, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো আচরণ করে। এখানে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে আরও সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু লাভ হলেই একসঙ্গে সব বিক্রি করে দেওয়া ঠিক নয়।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে অনেকগুলো দুর্বলতা আছে। আমাদের জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন অনেক কম। শিল্পায়নে ব্যাংকের তুলনায় পুঁজিবাজার থেকে কম অর্থায়ন হয়। কাঙ্ক্ষিত বিদেশি বিনিয়োগ নেই। এগুলো নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। তার মতে, একটি দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ১০-১২টি বিষয়ের দরকার আছে। এরমধ্যে আইন কানুন অন্যতম। আর আইন কানুন আমাদের আছে। এছাড়া সরকার সহযোগিতা করছে।

ড. এম খায়ররুল হোসেন বলেন, ভালো কোম্পানি বাজারে আসছে না। এজন্য অনেকগুলো কারণ আছে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে শেয়ারবাজার নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। কারণ তাদের ধারণা এই বাজারে গেলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। দ্বিতীয়ত ব্যাংক থেকে সহজেই দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলো পরিশোধ করতে হয় না। এছাড়া তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কর হার ব্যবধান কম।

বিএসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় দরকার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, আইডিআরএ, বিটিআরসি, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনসহ যেসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়, সেসব নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। দেশে প্রথমবার ২০২০ সালে ফ্লোর প্রাইস (দাম কমার সীমা) হয়েছে। কারণ ওই বছরের শুরুতে করোনা পরিস্থিতির কারণে বাজারে অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরপর বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমবিএ’র নেতা মনিরুজ্জামান।

এমআই/জেডএস