রোড শোর পর বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো
বিদেশে ‘রোড শো’ করার পর বিভিন্ন দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজ, মধ্যস্থতাকারী ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে। আরও সুখবর হচ্ছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড বা ইটিএফ করছে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ডন গ্লোবাল। এছাড়া ব্রিটিশ ও চীনারা বড় আকারে বিনিয়োগের লক্ষ্যে কাজ করছে। বিনিয়োগের জন্য চীনারা একটি ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়েছে। এভাবে শত শত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে— অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি সাধারণ বীমা করপোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একাধিকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সিনেট সদস্য এবং কোষাধ্যক্ষ হন। পাশাপাশি ঢাবির বাণিজ্য অনুষদের ডিন হিসেবে চারবার দায়িত্ব পালন করেন।
টানা দরপতন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে আস্থার সংকটে ভুগছে দেশের পুঁজিবাজার। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের পরও গত দুই মাসে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন প্রায় আড়াই লাখ বিনিয়োগকারী। এমন পরিস্থিতিতে বাজারের স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে করণীয় সম্পর্কে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান। বলেন, ‘পুঁজিবাজার তো সবজি বা মাছের বাজার নয়। এটা বিনিয়োগ। বিনিয়োগ কেন সবজি বা মাছের বাজারের মতো হবে।’ দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষটি থাকছে আজ।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন >> ৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করলেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা
ঢাকা পোস্ট : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট নেই। আবার যাদের আছে সেগুলো ঠিক মতো আপডেট হয় না। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিএসইসি) চেয়ারম্যান হিসেবে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না?
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম : নিয়ম অনুযায়ী পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থাকতে হবে। যাদের নেই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাদের আছে কিন্তু অসম্পূর্ণ, তাদের সতর্ক করা হবে। এরপরও সংশোধন না হলে শাস্তি দেওয়া হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান আইপিওর শর্ত সঠিকভাবে পরিপালন করছে না তাদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তাদের শাস্তি দেওয়া হবে।
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোড শো আয়োজন করা হয়েছে। দৃশ্যমান কোনো প্রভাব পড়েছে কি?
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম : রোড শো শুরু হয়েছে মাত্র এক-দেড় বছর আগে। এখনই শত শত প্রতিষ্ঠান ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজ, মধ্যস্থতাকারী ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে। আরও সুখবর হচ্ছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড বা ইটিএফ করছে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ডন গ্লোবাল।
আরও পড়ুন >> কারসাজি চক্রের ইশারায় উত্থান-পতন, দায় কার?
গত দুই সপ্তাহে তিনজন বিদেশি উদ্যোক্তা বিএসইসি কার্যালয়ে আসেন। এর মধ্যে একটি দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠান, একটি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানটি অল্পকিছু অর্থ বিনিয়োগ করে পরীক্ষা করেছে। এখন তারা বড় আকারে বিনিয়োগ করবে। ব্রিটিশ ও চীনারা বড় আকারে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিনিয়োগের জন্য চীনারা একটি ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়েছে। এভাবে শত শত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে।
এছাড়া অবকাঠামো বন্ডগুলো ছাড়া শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে বিনিয়োগ আসবে। তারা শরিয়াভিত্তিক ইসলামি সুকুক বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। অথচ দেশগুলো বাংলাদেশে যে একটি বাজার আছে সেটি তারা জানত না। রোড শো’র ব্র্যান্ডিংয়ের ফলে তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পেরেছে।
ঢাকা পোস্ট : গত দুই বছরে শেয়ার কারসাজিসহ নানা অনিয়ম করেছে বেশকিছু বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠান। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি-না? ক্ষতির পরিমাণ কতটুকু— আপনাদের কাছে কোনো তথ্য আছে কি-না?
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম : পুঁজিবাজারে কারসাজি করেছে, এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতি সপ্তাহেই কমিশন সভায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ফলে গত ২০ বছর ধরে আটকে থাকা এক হাজার মামলার (অভিযোগ) মধ্যে ৭০০টির সমাধান করেছে এনফোর্সমেন্ট বিভাগ। এগুলোর মধ্যে কাউকে সতর্ক, কাউকে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে ফৌজধারি মামলাও হয়েছে। বাকিগুলো দ্রুত শেষ করার ইচ্ছা আছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির কাজ চলছে।
আরও পড়ুন >> পুঁজিবাজারের টাকা যাচ্ছে ডলার মার্কেটে!
ঢাকা পোস্ট : পুঁজিবাজারের স্থিতিশীল ফান্ডে ২০-২১ হাজার কোটি টাকা থাকা কথা। কিন্তু আছে ১১শ কোটি টাকা। বাকি টাকা গেল কোথায়?
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম : পুঁজিবাজারে বড় বড় অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা দীর্ঘদিন বিনিয়োগকারীদের টাকা ও শেয়ার আটকে রেখেছিল। বলছিল, লোক পাচ্ছি না। বিএসইসি’র পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়ার পর এখন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, লোক পাচ্ছে। পাওনা টাকা ও শেয়ার সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিএসইসি’র উদ্যোগের পর সাত-আট হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগকারীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে। টাকাগুলো সঠিক স্থানে দেওয়া হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে আমরা অডিট শুরু করেছি।
ঢাকা পোস্ট : এসএমই প্লাটফর্মে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, এখানে কারসাজি হচ্ছে। কমিশন কীভাবে দেখছে?
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম : এসএমই প্লাটফর্মে ১৪টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর ১০ টাকার শেয়ার বেড়ে ২০ টাকা, ৫০ টাকা কিংবা ১০০ টাকা হয়েছে। এতে কত লাভ হয়েছে? প্রতিষ্ঠানগুলোর পেইড-আপ ক্যাপিটাল মাত্র দুই কোটি, তিন কোটি কিংবা পাঁচ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়িয়ে কারসাজি করে কেউ তো এক কোটি টাকা লাভ করতে পারবে না! এখন যদি কেউ কিছু করে তাও হবে ছোট আকারের।
এটিও বিএসইসি’র নজরদারির মধ্যে রয়েছে। যারাই কারসাজি করছে, তাদের ডেকে এনে সতর্ক এবং জরিমানাও করা হচ্ছে।
যারা ভালো বাজার বোঝেন তারা সবসময় সুযোগ খোঁজেন। এখন শুধু এসএমই নয়, সামনে দেখবেন বন্ড ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডেও বিনিয়োগের সুযোগ আসবে। তখন বুদ্ধিমান এসব লোক বন্ড ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে মুনাফা তুলে নেবে।
আরও পড়ুন >> হুন্ডিতে ২ লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য!
ঢাকা পোস্ট : বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাদের ধরে রাখতে আপনাদের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কি-না?
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম : রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে ডলারের বাজার অস্থিতিশীল। এ কারণে বিদেশিরা টাকা তুলে নিচ্ছেন। ডলারের বাজার স্থিতিশীল হলেই তারা আবারও বিনিয়োগ করবেন।
ঢাকা পোস্ট : বাজারে অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রাইস সেনসিটিভ ইনফরমেশন সঠিক থাকে না। অনেকে এটা নিয়ে কারসাজি করেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া তথ্য আপনারা যাচাই-বাছাই করেন কি-না?
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম : যারা এ ধরনের কাজ করছে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
ঢাকা পোস্ট : পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। এর সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে যদি বলতেন...
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম : আমরা নিজেরা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুরোধ করে যাচ্ছি প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাভুক্ত করার জন্য। এরই মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান কথা বলে গেছে। আস্তে আস্তে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারে আসবে। কারণ, অর্থ মন্ত্রণালয় খুবই শক্তভাবে তাদের পুশ করছে। মনে হয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কিছু প্রতিষ্ঠান বাজারে আসবে।
আরও পড়ুন >> রেমিট্যান্সের ডলার ১০৮ টাকায় কিনবে ব্যাংক
ঢাকা পোস্ট : ইউনিলিভার, বাংলালিংকসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে আনার বিষয়ে নতুন কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি-না?
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম : ইউনিলিভার এখনও আসেনি। তবে, বাংলালিংক আমাদের কাছে এসেছে। এটি তালিকাভুক্ত হওয়ার পথে। প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর ধরে লোকসানে আছে, আইনি জটিলতাও আছে। তারপরও বাংলালিংককে বাজারে আনার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।
এছাড়া দেশীয় বড় বড় প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আসতে চাচ্ছে। বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আসতে রাজি হচ্ছে না। তারা আরেকটু বেশি মূল্য চাচ্ছে। এগুলো আলোচনার মধ্যে আছে। আমরা সহজ উপায়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এমআই/এমএআর/