কেয়া কসমেটিকসের শেয়ারেও গুজবের হাওয়া!
‘মালিকানা পরিবর্তন’, ‘উৎপাদনে ফিরবে’, ‘ভালো মুনাফা দেবে’-এমন বিভিন্ন গুজবে গত কয়েকদিন ধরে দেশের পুঁজিবাজারে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে। তাতে লোকসানে থাকা, উৎপাদন বন্ধ থাকা বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এবার সেই গুজবের হাওয়ায় যোগ হয়েছে ঋণে জর্জরিত কেয়া কসমেটিকসের শেয়ার।
জানা যায়, মূলধনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ঋণে জর্জরিত কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড। কোম্পানিটির মালিকদের বিরুদ্ধে রয়েছে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের মামলা। শুধু তাই নয়, গত দুই বছর ধরে আর্থিক প্রতিবেদনও দিচ্ছে না কোম্পানিটি। এরপরও হঠাৎ করেই ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ছে।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, ২০০১ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বুধবার (৩১ আগস্ট) বেড়েছে ৬০ পয়সা বা ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর সবশেষ চার কার্যদিবসে শেয়ারটির দাম ৭০ পয়সা বেড়ে ৭ টাকা ১০ পয়সায় উঠেছে।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বাজারে খবর চড়াও হয়েছে, কোম্পানিটির মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে। তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, এই খবর সত্য নয়, সম্পূর্ণ গুজব। এই গুজব আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনছি। কোনো গ্রুপ কিংবা মালিক বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে কোম্পানির মালিকানা কিনে নিচ্ছে, এ রকম কোনো খরব আমাদের কাছে নেই।
সাদ সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী হাফিজ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাকে কয়েকজন বিনিয়োগকারী জানিয়েছেন যে, কেয়া কসমেটিকসের মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে, মঙ্গলবার থেকে শেয়ার ‘টান দেবে’, বাজারে দেখলাম সত্যি সত্যিই তো টান দিলো।
মূলধনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ঋণে জর্জরিত কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড। কোম্পানিটির মালিকদের বিরুদ্ধে রয়েছে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের মামলা। শুধু তাই নয়, গত দুই বছর ধরে আর্থিক প্রতিবেদনও দিচ্ছে না কোম্পানিটি।
বিনিয়োগকারী আবু সালেহ রনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছরও শুনেছি কোম্পানিটির মালিকানা পরিবর্তন হবে, শুনে ১০ হাজার শেয়ার কিনেছিলাম। কিন্তু পরে এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমি ধরা, এখন আবারও একই সুর শুনছি।
ফাস্ট ক্যাপিটালের কর্মকর্তা মামুন উর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেসব বিনিয়োগকারী শেয়ার কিনে ধরা খেয়েছে, তারা কিছুদিন পরপরই কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে বলে গুজব ছড়ায়। তারপর দাম বাড়লে বিক্রি করে সটকে পড়ে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মালিকানা পরিবর্তনের খবরটির বিষয়ে জানতে চাইলে কেয়া কসমেটিকসের কোম্পানি সচিব নূর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় দিনই কোনো না কোনো বিনিয়োগকারী ফোন দিয়ে জানতে চান কবে কার সঙ্গে মালিকানা পরিবর্তন হবে, আমি এই শুনে শুনে বিরক্ত।
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে কেয়া কসমেটিকস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক পাঠান, তার স্ত্রী ও তিন সন্তানের বিরুদ্ধে পৃথক মোট ৫টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তিনি বলেন, এই কোম্পানি যদি আরেক কোম্পানির উদ্যোক্তারা কিনতে চায় তবে ফরমালি চিঠি দেবে। আমরা আজ পর্যন্ত এ রকম কোনো চিঠি পাইনি কিংবা চিঠি দিয়েছে বলে শুনিনি। এটা সম্পূর্ণ গুজব ও মিথ্যা।
কোম্পানির অবস্থা
২০০১ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি গত ২০ বছরে শেয়ারহোল্ডারদের মাত্র ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। বাকি ১৯ বছরের মধ্যে ৯ বছরই লভ্যাংশ দিয়েছে বোনাস শেয়ার। আর ১০ বছর শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করেছে।
কোম্পানিটি জুলাই ২০১৯ থেকে জুন ২০২০ অর্থবছরে ১ শতাংশ (অর্থাৎ শেয়ার প্রতি ১০ পয়সা) লভ্যাংশ দিয়েছে। এরপর ২০২১ ও ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ফলে বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন অন্ধকারে। এই অবস্থায় কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমে ফেসভ্যালুর নিচে নেমেছে।
ডিএসইর তথ্য মতে, ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ছিল ৪ টাকা ৫০ পয়সা। সেখান থেকে হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী বাজারে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট ১০ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হয়। এরপর শেয়ারটির দাম কমতে শুরু করে, যা অব্যাহত ছিল চলতি বছরের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত। এই সময়ে শেয়ারটির দাম কমতে কমতে ৬ টাকা ৪০ পয়সায় নামে। আর শেয়ারটি কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১১০ কোটি ২৩ লাখ ১৭ হাজার ৩২৫ শেয়ারধারী।
ঋণে জর্জরিত কেয়া কসমেটিকস
২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, কোম্পানিটির মূলধন হলো ১ হাজার ১০২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এই কোম্পানির বর্তমান ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৮৭২ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ মূলধনের চেয়ে ঋণ প্রায় দ্বিগুণ।
এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৭৪২ কোটি ৯১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ১ হাজার ১৩০ কোটি ৯১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ঋণের পাশাপাশি কোম্পানির রিজার্ভও ঋণাত্মক রয়েছে ৮৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
কেয়া কসমেটিকসের মালিকদের নামে ৫ মামলা
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে কেয়া কসমেটিকস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক পাঠান, তার স্ত্রী ও তিন সন্তানের বিরুদ্ধে পৃথক মোট ৫টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের অভিযোগ, পরিবারের সদস্যরা মিলে প্রায় ১৮৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও ৯৬ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চেয়ারম্যান আবদুল খালেকের স্ত্রী ফিরোজা বেগম, ছেলে মাসুম পাঠান ও তার মেয়ে তানসীন কেয়া কসমেটিকসের পরিচালক। তার আরেক মেয়ে খালেদা পারভীন কেয়া কসমেটিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।
২০২১ সালের শেষ দিকে দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারাসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২০১২ এর ৪ (২) ধারায় কেয়া কসমেটিকসের পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শফি উল্লাহ।
সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগের পরামর্শ
দুই বছর ধরে হদিস না থাকা, ঋণ-মামলায় জর্জরিত এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমদ।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গুজব নির্ভর কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করাই উত্তম। শতভাগ লাভ হলেও সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে এসব কোম্পানিতে।
কোম্পানির বক্তব্য
কেয়া কসমেটিকসের কোম্পানি সচিব নূর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন সমস্যার কারণে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। তবে এখন অডিট চলছে। অডিট শেষ হলে বোর্ড সভার পর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
তিনি বলেন, নিয়ম অনুসারে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এরপর গণমাধ্যমেও প্রকাশ করা হবে।
আমাদের কাছে মালিকানা পরিবর্তন কিংবা মূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কেউ যদি মালিকানা পরিবর্তন করতে চায় তবে তার প্রস্তাব কমিশনে অব্যশই আসতো। আমাদের কাছে এ রকম কোনো তথ্যে আসেনি।
গত দুই বছর ধরে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করার বিষয়ে তিনি বলেন, নিয়ম অনুসারে প্রতি প্রান্তিকের প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। না দিলে আইন অনুসারে কোম্পানির বিরুদ্ধে শাস্তি হবে।
এমআই/জেডএস