রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে টাকার মান আরও হারানোর ভয়ে পুঁজিবাজার থেকে গত দুই মাসে ৫১৩ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন বিদেশিরা। গত এপ্রিল ও মে মাসে শেয়ার বিক্রি করে তারা এই টাকা তুলে নেন। একই সঙ্গে তারা বাজারও ছাড়ছেন।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বিএসইসি’র তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে বিদেশিরা ২৪৪ কোটি ৬৫ লাখ পাঁচ হাজার টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন। মে মাসে তারা বিক্রি করেছেন ২৬৯ কোটি ৩১ লাখ এক হাজার টাকার শেয়ার। যা এপ্রিলের তুলনায় ২৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বেশি। দুই মাস মিলিয়ে অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫১৩ কোটি টাকার বেশি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চার কারণে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। প্রথমত, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। তার ধাক্কা বাংলাদেশে পড়েছে। ফলে বেশকিছু দিন ধরে ডলারের বাজার অস্থির। তারা বলেন, একদিকে পুঁজিবাজার টালমাটাল, অন্যদিকে ডলারের বাজার অস্থির। এ কারণে বিদেশিরা পুঁজি হারানোর ভয়ে শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত, বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অতি মূল্যায়িত হওয়ায় বিদেশিরা মুনাফা তুলতে তা বিক্রি করে দিচ্ছেন। তৃতীয়ত, পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি’র দ্বন্দ্ব। এ কারণে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোরতর অবস্থান নেওয়ায়, এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান বিদেশিরা। এ কারণে তারা দেশীয় বড় বিনিয়োগকারীদের মতো শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন।

চতুর্থ কারণ হলো, বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব। পাশাপাশি বিনিয়োগযোগ্য ভালো কোম্পানির অভাব রয়েছে বাজারে।

পুঁজিবাজার ছেড়েছেন ৪৮৭ বিনিয়োগকারী

সিডিবিএল’র তথ্য মতে, চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের  হিসাব ছিল ২০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪৬টি। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ৭৮ হাজার ১৬৭৩টি। বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ৭৮ হাজার ২৯৯টি।

১৫ জুন পর্যন্ত সময়ে সেখান থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা ৪৮৭টি কমে দাঁড়িয়েছে ৭৭ হাজার ৮১২টিতে। অর্থাৎ দেড় মাসের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা কমেছে প্রায় ৫০০টি। একটি বিওতে একজন বিনিয়োগকারী ধরা হলে গত দেড় মাসে আরও প্রায় ৫০০ বিনিয়োগকারী বাজার ছেড়েছেন।

শেয়ার বিক্রির হালচাল

গত এপ্রিলে বিদেশিরা ৩০৮ কোটি ৯৪ হাজার টাকার লেনদেন করেন। এর মধ্যে তারা শেয়ার কিনেছেন মাত্র ৬৪ কোটি ২৮ লাখ টাকার। বিপরীতে শেয়ার বিক্রি করে তুলে নিয়েছেন ২৪৪ কোটি ৬৫ হাজার টাকা।

একই অবস্থা দেখা যায় মে মাসেও। এ মাসে বিদেশিরা শেয়ার কিনেছেন মাত্র ৯৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকার। বিপরীতে বিক্রি করেছেন ২৬৯ কোটি ৩১ লাখ টাকার শেয়ার। অর্থাৎ তারা ১৭৩ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়েছেন।

৩১ মে পর্যন্ত  ডিএসই’র ১৩০টি কোম্পানিতে বিদেশি ও প্রবাসীদের শেয়ার ছিল। এর মধ্যে টাকার অঙ্কে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটিবি) শেয়ার সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছেন তারা। এরপরে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মা, আইডিএলসি ফাইন্যান্স ও স্কয়ার ফার্মা। 

অর্থনীতিবিদদের অভিমত

বিদেশিরা সবসময় স্থিতিশীল বাজারে শেয়ার কেনেন— উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে টাকার মান কমছে। ডলারের প্রাইস ওঠা-নামা করছে। প্রাইস ফিক্স হলে বিদেশিরা হিসাব করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবেন। 

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডলারের কারণ তো আছেই, পাশাপাশি পুঁজিবাজারের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি’র দ্বন্দ্ব এখনও কমছে না। ফলে বাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিদেশিরা স্পষ্ট ধারণা পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় কিছু বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তারা সেফ জোনে চলে যাচ্ছেন।

বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে ভালোর চেয়ে খারাপ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি। শুধু তা-ই নয়, দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ভালো কোম্পানি খুব কম রয়েছে। নতুন কোম্পানি না পাওয়ায় বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

ডিএসই’র বক্তব্য

বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চিফ অপারেটিং অফিসার ও মুখপাত্র এম সাইফুর রহমান মজুমদার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও ডলারের বাজারে অস্থিরতায় এখন বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, গত বছর ও চলতি বছরের প্রথম দুই মাস বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করেছেন বেশি। কিন্তু কী কারণে শেয়ার বিক্রি করছেন, তা জানা নেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে। বিএসইসি’র রোড শোতে আমরা বড় টিম পাঠাচ্ছি, তারা কাজ করছে। আমরা নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, দুবাইসহ সব দেশের প্রবাসী ও সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের পুঁজিবাজারে আসতে উদ্বুদ্ধ করছি।

ডিএসই’র পরিচালক শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশিরা গবেষণা করে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেন। তারা যখন দেখেন বিনিয়োগ করলে লাভ হবে তখন ফিক্সড লাভের আশায় বিনিয়োগ করেন। কিন্তু ডলারের বাজার অস্থির হওয়ায় তারা শেয়ার বিক্রি করে অর্থ তুলে নিচ্ছেন।

বিএসইসি’র বক্তব্য

বিএসইসি’র কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববাজারে ডলারের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সৃষ্ট এ সমস্যার কারণে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার থেকেও শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন বিদেশিরা। তারা বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। যেসব শেয়ারের দাম কম, বিনিয়োগ করলে প্রফিট বেশি হবে সেগুলোতে বিনিয়োগ করবেন।

তিনি বলেন, আমাদের এখানে বিনিয়োগ বিশ্বের যেকোনো পুঁজিবাজার থেকে ভালো। এখানে বিনিয়োগ করলে ভালো মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা এ বাজারে বিদেশি ও প্রবাসীদের আকৃষ্ট করতে বিশ্বব্যাপী রোড শো করছি, ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি। এটি ঠিক হয়ে যাবে।

বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্ট বলেন, ডলারের অস্থিরতায় শেয়ার বিক্রি বেড়েছে। তবে আগামী জুলাই থেকে বিদেশিরা শেয়ার কিনতে শুরু করবেন বলে আশা করছি।

এমআই/জেডএস