আস্থার সংকটে উল্টো পথে পুঁজিবাজার
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা আবারও আস্থার সংকটে পড়েছেন। নতুন বছর শুরুর এক মাস যেতে না যেতেই উল্টো পথে দেশের শেয়ার বাজার। আস্থা সংকটের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের বড় বিনিয়োগকারীরা সাইডলাইনে অবস্থান করছেন। ফলে প্রতিনিয়তই কমছে লেনদেন ও শেয়ারের দাম।
পরিস্থিতি এতো খারাপ হয়েছে যে, গেল মাসে বিনিয়োগকারীদের সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পুঁজি (মূলধন) উধাও। তাতে আস্থা সংকটের পর তারল্য সংকটও দেখা দিয়েছে পুঁজিবাজারে।
বিজ্ঞাপন
বাজার সংশ্লিষ্টরা এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। জেনে-বুঝে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, হাজার কোটি টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে পুঁজিবাজারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই অবস্থা সাময়িক, দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
এর পেছনে পাঁচটি কারণ রয়েছে বলে দাবি বাজার সংশ্লিষ্টদের। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-
>> পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দ্বন্দ্ব।
>> কিছু কোম্পানি শেয়ারের দাম অতিমূল্যায়িত হয়েছে। এখন এই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরে সংশোধন চলছে।
>> বাজারে চাহিদার তুলনায় ঘন ঘন আইপিওর (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) অনুমোদন।
>> রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন গুজব।
>> সম্প্রতি ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক মিলে ১১৬টি প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার নেগেটিভ ইকুইটিকে দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশনা দিয়েছে বিএসইসি।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব ইস্যুকে সামনে এনে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য একটি গ্রুপ নিষ্ক্রিয় রয়েছে। আরেকটি গ্রুপ কম দামে শেয়ার কেনার জন্য বাজারে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে দরপতন ঘটাচ্ছে। তাতে ঊর্ধ্বমুখী পুঁজিবাজার হঠাৎ টালমাটাল হয়ে উঠেছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি তুলে নিচ্ছেন।
পুঁজিবাজারে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শেয়ার ও বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য মতে, বর্তমানে পুঁজিবাজারে মোট ২০ লাখ ৬৪ হাজার বিওধারী রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ বিও হিসাবে শেয়ার রয়েছে। এই ১৫ লাখ বিও হিসাবের মধ্যে মাত্র দেড় লাখ বিনিয়োগকারীদের বিও সক্রিয়ভাবে লেনদেন হচ্ছে। অর্থাৎ বাকি ১৩ লাখ বিও হিসাবধারী বাজারে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। তারা বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন।
ডিএসইর তথ্য মতে, চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত এক মাসে একদিন সূচকের উত্থান হলে তিন দিন দরপতন হয়েছে। ফলে ডিএসইর অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। শেয়ারের দাম কমায় ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৯৩ পয়েন্ট কমে ৭ হাজার ৩২ পয়েন্ট থেকে ৬ হাজার ৮৩৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
গড় লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে এক হাজার কোটি টাকার নিচে অবস্থান করছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ৮৮৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এ সময়ে শেয়ার ও লেনদেন কমায় বিনিয়োগকারীদের পুঁজি উধাও হয়েছে ১২ হাজার ৪৫৫ কোটি ৫৬ লাখ ৪৯ হাজার টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারের দরপতনের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় রয়েছে। প্রথমে তারা বলছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের সীমা বাজার মূল্যের নিয়ম বাদ দিয়ে কস্ট প্রাইস বেসিসে (কেনা মূল্যে) গণনা করবে। কিন্তু তারা পরক্ষণেই গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায় যে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সীমা বাজার মূল্যেই গণনা করা হবে।
# সাইডলাইনে প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরা
# এক মাসে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পুঁজি উধাও
# দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে : বিএসইসি
তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, এখন থেকে প্রতি মাসে কোন ব্যাংক কত শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে তার তথ্য দিতে হবে। সর্বশেষ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে আরও স্পষ্টীকরণ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) নিজস্ব সাবসিডিয়ারি কোম্পানিকে দেওয়া ইকুয়িটি, দীর্ঘমেয়াদি ইকুয়িটি বিনিয়োগ বা ভেঞ্চার ক্যাপিটালকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে না। এর ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের সক্ষমতা কমেছে। এই সার্কুলার জারির পর থেকে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দরপতনের পাল্লা ভারি হচ্ছে।
অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এক সময় পুঁজিবাজারে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী থাকলেও এখন তা কমে ২০ লাখে নেমেছে। এই বাজারে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কোম্পানিকে আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। যার ৮০-৯০ শতাংশ খারাপ কোম্পানি। ফলে বাজারে নতুন শেয়ার আসার কারণে তারল্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে বাজারে একটি সমস্যা বিদ্যমান। তা হলো- ব্রোকার হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর নেগেটিভ ইকুইটি। বিএসইসি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সব ব্রোকারেজ ও মার্চেন্ট ব্যাংককে নেগেটিভ ইকুইটি মুক্ত রাখতে বলেছে। ফলে ব্রোকারেজ হাউজগুলো ফোর্স সেল শুরু করেছে। তাই দরপতন হচ্ছে। আর দরপতনের ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে।
সম্প্রতি বিএসইসির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১১৬টি ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের নেগেটিভ ইকুইটি রয়েছে ৮ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। ২০১০ সালের ধসের সময়ে এই নেগেটিভ ইকুইটির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক যুগে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা কমেছে।
ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, আমাদের পুঁজিবাজার চলে গুজবে। ফলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর দিন (বৃহস্পতিবার) দেশের পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছে। ইউরোপে যুদ্ধ হচ্ছে তাতে বাংলাদেশের কী কোনো সমস্যা হবে? তারপরও কেন শেয়ার বিক্রি করতে হবে?
ডিএসইর সাবেক এই সভাপতি বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা গুজবে কানে দেন। এ কারণে তারা বেশিরভাগ সময় লস করেন। আর বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীরা সব সময়েই লাভ করেন।
তার সঙ্গে একমত পোষণ করে ডিএসইর পরিচালক ও ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট শরীফ আনোয়ার হোসেন।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিছু বিনিয়োগকারী এখন মুনাফা নিয়ে সাইডলাইনে রয়েছেন। বস্ত্র ও বিমাসহ বেশ কিছু খাতের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে শেয়ারের দাম অতিমূল্যায়িত করে কিছু বিনিয়োগকারী মুনাফা নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। এখন সেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। কিন্তু যারা ভালো কোম্পানির শেয়ার অর্থাৎ ফান্ডামেন্টাল কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন সেই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমছে না। তারা ভালো আছেন।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থার কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে বাজার এমন হতে পারে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কারেকশনের ডাইমেনশন। আর দ্বিতীয়টি হলো- কিছু ক্ষেত্রে পলিসির পরিবর্তন। সেগুলো মার্কেটকে ডি-প্রাইভ করছে।
বিএসইসির কমিশনার বলেন, এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন রাজস্ব নীতি, মুদ্রানীতি ও পুঁজিবাজার নীতি। এই তিনটি নীতি সুসংগঠিত করতে পারলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। বিনিয়োগকারীদের অবস্থার পরিবর্তন হবে।
এই অবস্থা সাময়িক সময়ের জন্য উল্লেখ করে অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
এমআই/ওএফ