গ্রাহকদের বিমার ৭০ কোটি টাকা অবৈধ ব্যয় দেখিয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বিমা কোম্পানি সানলাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কঠোর নির্দেশনার পরও ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কোম্পানির এমডি-চেয়ারম্যান এবং পরিচালনা পর্ষদের সমন্বয়ে এ টাকার খরচ দেখানো হয়েছে। 

শুধু তাই নয়, এ অবৈধ ব্যয়কে বিমা কোম্পানিটি বলছে অতিরিক্ত ব্যয়। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে, ভ্রমণ ব্যয়, বাড়ি-গাড়ি, খাতা-পত্র, চেয়ার-টেবিল এবং বাড়ি-ভাড়াসহ বিভিন্নভাবে খরচ দেখিয়ে ৭০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখবে আইডিআরএ।

২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির মালিকানায় রয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জাহিদ মালেক ও তার পরিবারের সদস্যরা। এ কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মন্ত্রীর বোন অধ্যাপক রুবিনা হামিদ। প্রতিষ্ঠানটিতে শেয়ারহোল্ডার পরিচালক হিসেবে রয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রী শাবানা মালেক ও তার ছেলে রাহাত মালেক।

২০১৮ এবং ২০১৯ সালে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। এরপরের বছর মাত্র ১ শতাংশ অর্থাৎ শেয়ার প্রতি ১০ পয়সা করে নামমাত্র লভ্যাংশ দেয়। তারপরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি সানলাইফ ইনস্যুরেন্স।

তাদের পাশাপাশি রুবিনা হামিদের স্বামী কাজী আখতার হামিদ ও রাইয়ান হামিদও উদ্যোক্তা-পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। এছাড়াও শেয়ারহোল্ডার পরিচালক হিসেবে রয়েছেন শায়লা ফেরদৌস সান্তাজ বানু। তিনি এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক নূরুল ফজল বুলবুলের স্ত্রী।

আরও পড়ুন : পুঁজিবাজার সবজি-মাছের বাজার নয়

এছাড়াও কোম্পানির উদ্যোক্তা হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের শেয়ার রয়েছে ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ, মোস্তাক আহমেদের ২ দশমিক ২২ এবং ছায়েদুর রহমান খানের রয়েছে ১ দশমিক ১১ শতাংশ শেয়ার।

সব মিলে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে রয়েছে কোম্পানির ৪০ দশমিক ৮০ শতাংশ শেয়ার। আর বাকি ৫৯ দশমিক ২০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর এ বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা গত চার বছর ধরে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে কোনো লভ্যাংশ পাচ্ছেন না।

বিমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মের বাইরের ব্যয় রোধ হলে এ টাকায় গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধ করা যেত। পাশাপাশি এ টাকা আমানত হিসেবে রাখলে সেখান থেকেও মুনাফা আসত। সেই মুনাফার অংশ পেতেন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা। অবৈধ এই ব্যয়ের কারণে গ্রাহকরা কোম্পানিটিতে বিনিয়োগে আস্থাও হারাচ্ছেন।

সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত ব্যয় হয় ২০১৬ সালে। ওই বছর কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ২৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। এই বছর কোম্পানিটির ব্যয়ের অনুমোদন ছিল ৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা কিন্তু কোম্পানিটি ব্যয় করে ৭৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।

কোম্পানির তথ্য মতে, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। এরপরের বছর মাত্র ১ শতাংশ অর্থাৎ শেয়ার প্রতি ১০ পয়সা করে নামমাত্র লভ্যাংশ দেয়। তারপরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি সানলাইফ ইনস্যুরেন্স।

আরও পড়ুন : কেয়া কসমেটিকসের শেয়ারেও গুজবের হাওয়া!

বিমা বিধিমালা ১৯৫৮ এর ৩৯ বিধি অনুসারে, জীবন বিমা কোম্পানি প্রথম বর্ষে ব্যবসার জন্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ ব্যয় করতে পারবে। এ আইন মোতাবেক কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২১৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। অথচ সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ব্যবস্থাপনা ব্যয় দেখিয়েছে ২৯০ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৭০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বেশি ব্যয় করেছে কোম্পানিটি। যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

৫ বছরে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় 

২০১৬ থেকে ২০২০ সালে কোম্পানিটি মোট ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ৭০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। 

বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর মতে, এ টাকা বিমা গ্রাহকের; তাই অতিরিক্ত ব্যয় অবৈধ।

অলোচ্য সময়ে কোম্পানির মোট প্রিমিয়াম আয় করে ৪৮৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আর ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করে ২৯০ কোটি ২৪ লাখ টাকা যা মোট আয়ের ৫৯ দশমিক ৩১ শতাংশ।

গত ৫ বছরের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত ব্যয় হয় ২০১৬ সালে। ওই বছর কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ২৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। এই বছর কোম্পানিটির ব্যয়ের অনুমোদন ছিল ৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা কিন্তু কোম্পানিটি ব্যয় করে ৭৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন : ধার করে ব্যবসা শুরু, সা’দ মুসা গ্রুপের এখন ২৭ প্রতিষ্ঠান

২০১৭ সালে অনুমোদন ছিল ৪৬ কোটি ৪ লাখ টাকা, ব্যয় করে ৫৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে অনুমোদন ছিল ২৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা, ব্যয় করেছে ৪৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয়ের অনুমোদন ছিল ৩৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, ব্যয় করেছে ৪৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১২ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয় বেশি দেখিয়েছে।

তবে ২০২০ সালে অনুমোদন সীমার চেয়ে কম ব্যয় করেছে কোম্পানিটি। ২০২০ সালে অনুমোদন ছিল ৬৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা। সেখানে কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ৫৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। যা ৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা কম। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে ৯০ কোটি ৭০ লাখ টাকা বেশি খরচ দেখিয়েছে কোম্পানিটি। সেগুলোর বিষয়ে আইডিআরএ ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

নিয়মের বাইরের ব্যয় রোধ হলে এ টাকায় গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধ করা যেত। পাশাপাশি এ টাকা আমানত হিসেবে রাখলে সেখান থেকেও মুনাফা আসত। সেই মুনাফার অংশ পেতেন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা। অবৈধ এই ব্যয়ের কারণে গ্রাহকরা কোম্পানিটিতে বিনিয়োগে আস্থাও হারাচ্ছেন।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শরিফুল ইসলামের ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। 

তবে কোম্পানি সচিব আব্দুল আজিজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আর্থিক প্রতিবেদনে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে, তা ঠিক আছে। নিয়মের বেশি করা হয়েছে কিনা এ বিষয়ে আমার জানা নেই।

এ বিষয়ে আইডিআরএর নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শাকিল আখতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেসব কোম্পানি নিয়মের বাইরে ব্যয় করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমআই/এসকেডি