করোনার মধ্যে ছাঁটাই, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাও মানছেন না তারা
মহামারি করোনাকালে খরচ কমানোর নামে অমানবিকভাবে কর্মী ছাঁটাইয়ের অভিযোগ উঠেছে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে। অনেককে আবার পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের কর্মীদের ছাঁটাই বন্ধ এবং কোভিডের সময় চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য করা কর্মীদের পুনর্বহালের নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এখন পর্যন্ত সেই নির্দেশনা পরিপালন করতে দেখা যায়নি কোনো প্রতিষ্ঠানকে।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যেসব ব্যাংক নির্দেশনা মানছে না তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিজ্ঞাপন
মহামারিতে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া যমুনা ব্যাংকের এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কর্তব্যরত অবস্থায় হঠাৎ মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগ (এইচআরডি) থেকে ফোন আসে। বলা হয়, আপনাকে এক মাসের সময় দেওয়া হলো, রিজাইন করেন। তা না হলে টার্মিনেট করা হবে। রিজাইন করলে পাওনাসহ সব সুবিধা পাবেন। টার্মিনেট করলে কিছুই পাবেন না। বাধ্য হয়ে অসহায়ের মতো পদত্যাগ করি।’
তিনি বলেন, গত ১৬ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন করে ছাঁটাই বন্ধ ও চাকরিচ্যুত ব্যাংকারদের পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়। এতে আশার আলো দেখি। নিয়ম মেনে আবেদনও করি। কিন্তু দেড় মাস হতে চলল কিছুই হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কোনো সমাধান পাচ্ছি না। ২০ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ার। দায়িত্বে কোনো অবহেলা করিনি। তারা কোনো ত্রুটিও দেখাতে পারেনি। অন্যায়ভাবে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। পুনরায় চাকরিতে বহাল চাই।
শুধু ওই কর্মকর্তা নয়, এমন শত শত ব্যাংকার বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দফতরে চাকরি ফিরে পাওয়ার আশা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না। তাদের প্রশ্ন, তাহলে কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাকরিতে পুনর্বহালের ওই নির্দেশনা দিল।
সম্প্রতি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ছাঁটাই হওয়া শতাধিক কর্মী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে নিজেদের দুর্দশার কথা বর্ণনা করেন তারা। লেখেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সুখে-দুঃখে ব্যাংকের সঙ্গে থেকে আন্তরিকতা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বিভাগীয় প্রধান, শাখা ব্যবস্থাপক, জোনাল হেডসহ বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে উন্নীত হয়ে বা দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। যার স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন সময়ে আমরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্টসহ নানাবিধ পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছি। এখানে যোগদানের পূর্বে আমরা সরকারি ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রাইভেট ও বিদেশি ব্যাংকে বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে অত্র ব্যাংকে পদোন্নতিসহ যোগদান করেছিলাম।’
চিঠিতে তারা আরও উল্লেখ করেন, ‘বর্তমানে আমরা প্রায় সবাই চাকরিজীবনের মাঝামাঝি কিংবা শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আমাদের সন্তানরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। আমাদের অনেকের গৃহনির্মাণসহ অন্যান্য ঋণের কিস্তি চলমান, যা আমাদের বেতন-ভাতা থেকে নির্বাহ করতাম। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, গত নভেম্বর মাসে ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক যোগদানের পর সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অন্যায় ও অমানবিকভাবে ব্যাংকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও শাখা প্রধানসহ মধ্যম ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের টার্মিনেট করা, সার্ভিস বেনিফিটসহ আর্থিক সুবিধাদি হতে বঞ্চিত করাসহ নানাবিধ হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।’
‘করোনাকালে যখন অন্যত্র চাকরি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তখন আমরা কেউই যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিনি বা আমাদের পদত্যাগের নোটিশ প্রদান করা হয়নি, তা সহজেই বোধগম্য ও অনুমেয়। ভয়ভীতি দেখিয়ে পদত্যাগ করানোর এ কার্যক্রম এখনও চলমান। ফলে সর্বত্র ছাঁটাই আতঙ্ক কাজ করছে এবং ব্যাংকের সব কাজকর্মে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এছাড়া ব্যাংকের দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনাম ও গ্রাহকের আস্থায় সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যা আমাদের জন্যও কষ্টের কারণ।’
চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ব্যাংকে তিন থেকে চারশ অতিরিক্ত জনবল রয়েছে— এমন তথ্য ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডকে জানিয়ে খরচ কমানোর যুক্তি দেখিয়ে ছাঁটাইয়ের সম্মতি গ্রহণ করেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রায় সমসংখ্যক বা তারও বেশি সংখ্যক নতুন কর্মকর্তা, যারা তার পরিচিত, তাদের নিয়োগ দিয়েছেন। লোকবল কমানোর বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে একটি অপকৌশলমাত্র। মূলত তিনি ব্যাংকের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, সৎ ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের সরিয়ে তার একান্ত অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে এ ধরনের অমানবিক ছাঁটাই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
চিঠিতে বলপূর্বক পদত্যাগের নোটিশে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘করোনার কারণে নিরুপায় হয়ে পদত্যাগ কার্যকরের সময়সীমা পেছানোর জন্য লিখিত ও মৌখিকভাবে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক অত্যন্ত নির্মমভাবে সব আবেদন উপেক্ষা করে বলপূর্বক গ্রহণ করা পদত্যাগের নোটিশ নির্ধারিত সময়ে কার্যকর করেছেন। এমনকি তিনি আমাদের সাক্ষাৎ পর্যন্ত দেননি।’
ছাঁটাই করা কর্মকর্তাদের মধ্যে করোনায় আক্রান্তরাও রয়েছেন উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, করোনার সময়ে যেকোনো ধরনের চাকরিচ্যুতি, ছাঁটাই এমনকি বেতন বন্ধ না করার বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারফরম্যান্স দেখানোর তথাকথিত সহজ ও নির্মম পন্থা বেছে নিয়েছেন। পদত্যাগের নামে চাকরিচ্যুতির শিকার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যোগ্যতা ও দক্ষতার ঘাটতি কিংবা ননপারফর্মার হওয়ার অভিযোগ একান্তই হাস্যকর। কারণ, এসব কর্মকর্তাই মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকটিকে বর্তমান অবস্থানে আনতে অবদান রেখেছেন। তাদের অনেকেই নিকট-অতীতে বা সাম্প্রতিক সময়ে তাদের ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছেন, বিভিন্ন উৎসাহমূলক পুরস্কারও পেয়েছেন।
‘সর্বোপরি ননপারফর্মার শনাক্তের পর প্রাসঙ্গিক কার্যক্রম যেমন- কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রয়োজনীয় সময় দান এবং লিখিত সতর্কীকরণ ব্যতীত বলপূর্বক ও ভয়ভীতি দেখিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করানো অত্যন্ত অন্যায়, অমানবিক ও অপরাধমূলক কাজ। বর্তমানে ব্যাংক ও ননব্যাংকিং আর্থিকপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সব সেক্টরে নিয়োগ স্থবির থাকায় আমাদের জীবন-জীবিকা অত্যন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে এবং মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়ে আমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি।’
অন্যদিকে, চাকরি থেকে ছাঁটাই বা বাধ্যতামূলক অপসারণ আমাদের ব্যক্তিগত ও পরিবারের সদস্যদের জন্য অত্যন্ত অসম্মানজনক ও আত্মসম্মান হানিকর। এছাড়া চাকরিচ্যুত ব্যাংক কর্মকর্তা/নির্বাহীদেরকে অন্য ব্যাংক/আর্থিকপ্রতিষ্ঠান এমনকি অনার্থিকপ্রতিষ্ঠান কেউই সহজে চাকরি দিতে সম্মত হন না। এ অবস্থায় আবেদন সসম্মানে আমাদের পুনর্বহাল করা হোক— উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
এ বিষয়ে জানতে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কল রিসিভ করেননি। মুঠোফোনে খুদে বার্তা দিলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
জোরপূর্বক চাকরিচ্যুত ব্যাংকারদের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেসরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকে পরিদর্শন কার্যক্রম চালায়। সেখানে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের (২০২১ সাল) আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট তিন হাজার ৩১৩ কর্মকর্তা ‘স্বেচ্ছায়’ চাকরি ছেড়েছেন। এর মধ্যে বয়স থাকার পরও স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখানো হয়েছে তিন হাজার ৭০ জনকে। এছাড়া ২০১ জনকে অপসারণ, ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত এবং ১২ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখানো বেশির ভাগ কর্মকর্তাই জানিয়েছেন, ‘স্বেচ্ছায় পদত্যাগের জন্য মৌখিকভাবে তাদের একটি সময় দেওয়া হয়েছিল। ওই তারিখের মধ্যে পদত্যাগ না করলে কোনো সুবিধা দেওয়া হবে না— এমন ভয় দেখানো হয়।’ এমন প্রেক্ষাপটে বাধ্য হয়ে তারা পদত্যাগ করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন শেষে ব্যাংককর্মীদের ছাঁটাই বন্ধে গত ১৬ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করা হয়। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ‘এখন থেকে সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত অভিযোগ ছাড়া কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। পাশাপাশি মহামারি কোভিডের সময় চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যাংককর্মীদের চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হলো।’
বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ’-এর জারি করা নির্দেশনায় আরও বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি থেকে দেশের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে বিপুল অঙ্কের আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে যা বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নসহ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ফ্রন্টলাইনার হিসেবে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সেবা দিতে গিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকে মারা গেছেন। করোনার এ সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা হলে কর্মীদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে মনোবল ও কর্মস্পৃহা কমে যাবে। ভবিষ্যতে মেধাবী ও অভিজ্ঞরা ব্যাংকে যোগদানে অনীহা দেখাবেন। দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং খাতের জন্য যা ক্ষতিকর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও কর্মস্পৃহা অটুট রাখার স্বার্থে এসব নির্দেশনা দেওয়া হলো।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যখন কোনো নির্দেশনা দেয় তা বুঝে-শুনে এবং বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেই দেয়। মহামারির সময় চাকরিচ্যুত বা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা কর্মীদের পুনর্বহালের বিষয়ে যে সার্কুলার দেওয়া হয়েছে তা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করেই দেওয়া হয়েছে। এখন যদি কোনো ব্যাংক এ নির্দেশনা না মানে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এসআই/এমএআর/এমএইচএস