মহামারিতেও বাড়ছে কোটিপতির হিসাব
করোনা মহামারি ও নানা সংকটের মধ্যেও আয় কমেনি বিত্তবানদের। ফলে দেশে বাড়ছে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৯১৮টি। দেশে মহামারি শুরুর আগে গত বছরের মার্চে কোটি টাকার আমানতের হিসাব ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। অর্থাৎ মহামারিতে ১৭ হাজার ২৯৩টি কোটি টাকার হিসাব বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২১ সালের জুন ভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞাপন
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। শুরু হয় লকডাউন-বিধিনিষেধ। বন্ধ হয়ে যায় বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান। মহামারির কারণে গোটা বিশ্বের মতো দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন আবার অনেকে কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতেও আমানতকারীর সঙ্গে কোটি টাকা জমার হিসাবের সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট ১২ কোটি ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৬টি হিসাব খোলা হয়। যেখানে জমা ছিল ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৭৬৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
মোট হিসাবের শূন্য দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ কোটিপতিদের। চলতি বছরের জুন শেষে কোটি টাকার হিসাব দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৯১৮টিতে। এসব হিসাবে জমা ছিল মোট ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ৪৪ শতাংশই কোটিপতি হিসাবধারীদের।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে ১০ হাজার ৫১ জন নতুন কোটিপতি ব্যাংক হিসাবে যুক্ত হয়েছে। এসময় কোটিপতি হিসাবগুলোতে আমানত বেড়েছিল ৬৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এদিকে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৬ হাজার ২৮টি এবং আমানত বেড়েছে ৩৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকে কোটিপতি হিসাব ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। এসব হিসাবে আমানত ছিল ৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।
কোটি টাকার আমানত বাড়ার দুটি কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মহামারির মধ্যেও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক। একই সঙ্গে গত ১০ বছর ধরে বাংলাদেশের আয়বৈষম্য ব্যাপক হারে বেড়েছে। যখন আয় বাড়ে সঙ্গে সঙ্গে আয়বৈষম্য বাড়ে, তখন উচ্চআয়ের মানুষের অর্থের যোগান বেড়ে যায়- এটা একটা কারণ।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এক সময় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ২১ থেকে ২২ শতাংশ উঠেছিল। গত অর্থবছরে এটা ৮/৯ শতাংশে নেমে এসেছে। যখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম হয়, তখন উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে যায়। ওই অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ থাকে কিন্তু সবাই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়, কারণ এখানে ঝুঁকি থাকে। এছাড়া সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন শর্তের কারণে সবাই যেতে চায় না। তাই সহজে ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমিয়ে থাকে। এসব কারণেই বড় আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে বলে তিনি জানান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জুন মাস শেষে এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮ হাজার ৬৯৪টি। তিন মাস আগেও ছিল ৭৪ হাজার ২২৯টি। পাঁচ কোটি এক টাকা থেকে ১০ কোটি পর্যন্ত জমা হিসাবের সংখ্যা ১১ হাজার ১৩টি, মার্চে ছিল ১০ হাজার ৪৯৯টি। ১০ কোটি এক টাকা থেকে ১৫ কোটির টাকার হিসাব রয়েছে তিন হাজার ৫৯৯টি, ১৫ কোটি এক টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে এক হাজার ৭৩২টি, ২০ কোটি এক টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে এক হাজার ১৮৫টি, ২৫ কোটি এক টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৮৩৯টি, ৩০ কোটি এক টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৪২৫টি এবং ৩৫ কোটি এক টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে ৩১৪টি হিসাব রয়েছে। ৪০ কোটি এক টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাব দাঁড়িয় ৫৯০টি। আলোচিত সময়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪২৭টিতে। যা চলতি বছরের মার্চে ছিল এক হাজার ৩৭০টি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল পাঁচ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এর পর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালে ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে।
এসআই/এসএসএইচ