করোনা মহামারিতেও ব্যাংকের আয়ে লুকোচুরি খেলা!
করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের আর্থিক খাত। ব্যবসায় মন্দার কারণে ঋণের কিস্তি ঠিক মতো আদায় হচ্ছে না। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে ঋণ বিতরণেও চলছে ভাটা। এরই মধ্যে ব্যাংক খাতের মুনাফায় বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে। বাড়ানো হচ্ছে আয়। মহামারির এ কঠিন সময়েও নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মুনাফা ও আয়ের লুকোচুরি খেলায় মেতেছে তফসিলি ব্যাংকগুলো!
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকটি কারণে ব্যাংকের আয় বাড়ছে। এর মূল কারণ, এখন ঋণ শোধ না করলেও কেউ খেলাপি হচ্ছেন না। ফলে বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) রাখার প্রয়োজনও পড়ছে না। এছাড়া অনাদায়ি ঋণের সুদ এখন চলে যাচ্ছে আয়ের হিসাবে। নানা ছাড় আর শিথিলতায় কাগজে-কলমে আয় নিয়ে স্বস্তিতে আছে ব্যাংকগুলো। যা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত— বলছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক ও ব্যাংকাররা। সুযোগ পেয়ে আগ্রাসী আয় দেখানোর চেয়ে সহনীয় পর্যায়ে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
এখন ঋণ শোধ না করলেও কেউ খেলাপি হচ্ছেন না। ফলে বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) রাখার প্রয়োজনও পড়ছে না। এছাড়া অনাদায়ি ঋণের সুদ এখন চলে যাচ্ছে আয়ের হিসাবে। নানা ছাড় আর শিথিলতায় কাগজে-কলমে আয় নিয়ে স্বস্তিতে আছে ব্যাংকগুলো। যা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত
দেশের বেশির ভাগ তফসিলি ব্যাংক চলতি হিসাব বছরে তাদের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন, ২০২১) ও অর্ধ-বার্ষিকীর (জানুয়ারি-জুন, ২০২১) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, অধিকাংশ ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) বেড়েছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩১টি ব্যাংকের মধ্যে ২৮টি চলতি বছরের প্রথমার্ধ ও দ্বিতীয় প্রান্তিকের আর্থিক হিসাব প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০২১ সালের প্রথমার্ধে ২৪টি অর্থাৎ ৮৫ দশমিক ৭১ শতাংশ ব্যাংকের ইপিএস বেড়েছে। তিনটি ব্যাংকের ইপিএস কমেছে। ব্যাংক তিনটি হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। একটির ইপিএস অপরিবর্তিত রয়েছে। এছাড়া ঢাকা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকের প্রথমার্ধের আর্থিক হিসাব নিয়ে পর্ষদ সভা হয়নি।
সংকটের মধ্যেও কেন আয় বাড়ছে— জানতে চাওয়া হয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের কাছে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, এবার প্রায় সব ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। ট্রেজারি বিলে ইনকাম হচ্ছে, শেয়ারবাজার থেকেও আয় বেড়েছে। স্প্রেড (ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান) থেকে আয় বেশি আসছে। অর্থাৎ ঋণের সুদ যে হারে কমেছে তার চেয়ে বেশি আমানতের সুদের হার কমেছে। এছাড়া এবার কস্ট অব ফান্ডও কম হচ্ছে।
‘সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, যারা এখন ঋণের কিস্তি নিয়মিত দিতে পারছেন না, শর্ত শিথিলতার কারণে আমরা সেগুলো ক্লাসিফাইড বা খেলাপি করছি না। উল্টো এ হিসাব আয় খাতে নিয়ে নিচ্ছি। ফলে ব্যাংকের ইনকাম বাড়ছে।’
ব্যাংক খাতের সামনের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে— জানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে বলা খুবই কঠিন। কারণ, সামনে কী হচ্ছে এখন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।’
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আয় কমার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো আয় দেখাতে পারতাম, কিন্তু দেখাইনি। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমরা প্রভিশন বাড়িয়েছি। এ কারণে আয় কম হয়েছে।’
‘এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলোর উচিত একটু রক্ষণশীল হওয়া। বেশি আয় না দেখিয়ে নিরাপত্তার জন্য প্রভিশনিং করা। তাহলে মার্কেট ভালো হলে এ টাকা বাজারে ছাড়া যাবে। তা না হলে যদি কোনো কারণে ভবিষ্যতে সমস্যা হয় তাহলে তো বিপদে পড়তে হবে। এ কারণে ব্যালেন্স শিট স্ট্যান্ডার রাখাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ’— মনে করেন এমটিবি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণের ৮ দশমিক ০৭ শতাংশ। কিন্তু তিন মাস আগেও গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ছয় হাজার ৮০২ কোটি টাকা।
এ খাতের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপির তালিকায় দেখানো হচ্ছে না। পুরো ২০২০ সাল এমন সুবিধা পেয়েছেন ঋণগ্রহীতারা। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের বিভিন্ন নীতিমালার শর্ত শিথিল করা হয়েছে। ফলে গত এক বছরে ঋণের কিস্তি না দিয়েও নতুন করে কেউ খেলাপি হননি। এসব সুবিধা উঠিয়ে নেওয়া হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হু হু করে বেড়ে লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
২০২১ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণের ৮ দশমিক ০৭ শতাংশ। কিন্তু তিন মাস আগেও গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ছয় হাজার ৮০২ কোটি টাকা
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টেকে বলেন, ব্যাংকগুলো এখন অল্প সময়ের মধ্যে বেশি আয়ের দিকে জোর দিচ্ছে। দুই থেকে তিন শতাংশ রেটে আমানত নিয়ে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে। ফলে আয় বেশি হচ্ছে।
‘এছাড়া এখন ঋণ শোধ না করলেও খেলাপি হচ্ছে না। প্রভিশনিং রাখতে হচ্ছে না। চাহিদা অনুযায়ী যে সুবিধা চাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা-ই দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের কোনো লাভ হচ্ছে না। এ কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ব্যাংকগুলো গতানুগতিকভাবে চলছে, নতুন কিছু করার চিন্তা তাদের নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও মনে করছে, যেভাবে চলছে এভাবেই চলতে থাকুক।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। এখানে যদি খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দেওয়ার কথা বলা হতো তাহলে ব্যাংকগুলো একটু সতর্ক হতো। কিন্তু কিছুই বলা হয়নি, গতানুগতিক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে তারা।
‘ব্যাংকাররা এখন গ্রাম্য-মহাজনের মতো আচরণ করছেন’— এমন মন্তব্য করে সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘তাদের মনোভাব হয়েছে, আমি তো মহাজন, আপনি আমার কাছে টাকা রাখবেন। আমি যখন খুশি তখন টাকা নেব। যেখানে বেশি সুদ পাব সেখানে যাব। এটি তো ব্যাংকের কাজ হতে পারে না।’
তিনি বলেন, করোনায় ঢালাওভাবে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এখন এ নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখন উচিত হবে, যেসব সুবিধা আর্থিক খাতকে দুর্বল করছে সেগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেওয়া। ঋণ শোধ না করার এমন সুবিধা চলতে থাকলে এ খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
এদিকে, ঋণ বিতরণ ও আদায় কম হলেও ব্যাংক খাতের আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) শিল্প খাতে ৯০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিতরণ কমেছে ৬৯৫ কোটি টাকা অর্থাৎ শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ। এছাড়া শিল্প ঋণে মার্চ পর্যন্ত বকেয়া স্থিতি দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা।
ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ ছয় থেকে নয় মাস (ঋণ ভেদে) উত্তীর্ণ হলেই মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এ সময়সীমা ১২ মাস পার হলে ঋণখেলাপির প্রথম ধাপ হিসাবে গণ্য হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ৯৮ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এ খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ছিল ৭০ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে মাত্র তিন মাসে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ২৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
এসআই/এমএআর