পরিণয়ের আগেই এক্সিম ও পদ্মার বিচ্ছেদের সুর
শরীয়াহভিত্তিক বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়া পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একীভূতকরণের প্রথম ধাপ হিসেবে সমঝোতা চুক্তিতে সইও করেছিল ব্যাংক দুটি। কিন্তু এখন দুটি পক্ষই পরবর্তী ধাপে যেতে অনীহা। এক পক্ষ সহযোগিতা নিয়ে নিজেরাই ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছে। অন্যপক্ষ নিজের ঘর সামলাতে ব্যস্ত সময় পার করছে।
ব্যাংক দুটির অভিযোগ, তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই অনেকটা জোরপূর্বক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে কোনো মতামত চাওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় একীভূত হওয়ার শর্ত হিসেবে নিরীক্ষার কাজও শেষ করেছিল পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংক। সেই নিরীক্ষা প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একীভূতকরণের বিষয়টি ঝুলে গেছে।
বিজ্ঞাপন
এক্সিম ও পদ্মার একীভূতকরণ প্রসঙ্গে এক্সিম ব্যাংকের একজন পরিচালক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন আমরা (এক্সিম ব্যাংক) নিজেদের সমস্যা সমাধানে হিমশিম খাচ্ছি। এই মুহূর্তে কীভাবে মার্জারের চিন্তা করবো? তাই এ বিষয়ে বোর্ড সভায় কোনো এজেন্ডাও রাখা হয়নি। ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সোমবার আমরা আলোচনা করেছি। একজন কর্মকর্তা মার্জারের বিষয় জানতে চাইলে আমরা বলেছি এ বিষয় কোনো চিন্তা করার সময় নেই। আপাতত নিজের ঘর গোছাচ্ছি। এস আলম, সিকদারদের মত গ্রুপগুলো ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। তাই এখন বড় বড় ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে কীভাবে অর্থ আদায় করবো এটাকে গুরুত্ব দিয়ে এগুচ্ছি।
এ বিষয়ে এক্সিম ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম স্বপন জানান, আমরা এখন পদ্মার ব্যাংককে একীভূত করতে চাচ্ছি না। বিষয়টি গভর্নরকে জানিয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। মানুষ এক্সিম ব্যাংকে প্রচুর আমানত রাখছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও আমরা তারল্য সহায়তা চেয়েছি। ইতোমধ্যে এক হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা পেয়েছি। সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা পাওয়া গেলে আরও সুবিধা হবে।
এক্সিম ব্যাংক যেমন পদ্মাকে একীভূত করতে চাচ্ছে না তেমনি পদ্মা ব্যাংকও একীভূত হতে চাচ্ছে না- এমনটাই জানিয়েছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) কাজি মো. তালহা।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত যেমন চাপিয়ে দিয়েছিল। এখন তারাই সিদ্ধান্ত নেবে কী করবে? তবে আমরাও একীভূত হতে চাই না। আমরা মনে করি একটু সহায়তা পেলে নিজেরাই ঘুরে দাঁড়াতে পারব। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহযোগিতা লাগবে।
এদিকে মার্জারের সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে পদ্মা ব্যাংক এমন অভিযোগ করে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, মার্জারের সিন্ধান্তের কারণে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। অনেক গ্রাহক আতঙ্কিত হয়ে আমানত তুলে নিয়েছে। অনেক কার্যক্রমই স্থবির হয়ে আছে। তাই নিজেরা ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছি; একটু সহযোগিতা পেলে নিজেরাই ঘুরে দাঁড়াতে পারবো।
এক্সিম ও পদ্মার মার্জার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ব্যাংক দুটি এক হবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ব্যাংকিং টাস্কফোর্স। তারা ব্যাংকগুলোকে নিরীক্ষা করে দেখবেন। কোন ধরনের সমস্যায় আছে, কীভাবে সমাধান করা যায় তার সুপারিশ করবে। এরপরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিকে দুর্দশায় পড়া পদ্মা ব্যাংককে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করতে চলতি বছরের ১৮ মার্চ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর থেকে পদ্মা ব্যাংক আমানত সংগ্রহ কার্যত বন্ধ আছে। নতুন ঋণ দিচ্ছে না। পুরোনো ঋণ তদারকি এবং শাখা পর্যায়ে দৈনন্দিন ব্যাংকিং কার্যক্রম চলছে। এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার এক মাস পরেই পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খান পদত্যাগ করে চলে যান। সম্প্রতি তিনি বেসরকারি আরেকটি ব্যাংকে যোগ দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
তারল্য জোগান দেওয়ার কারণে পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদে বসতেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সোনালী ব্যাংক থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত আরো তিন ব্যাংক জনতা, অগ্রণী ও রূপালীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ শূন্য হওয়ায় পদ্মা ব্যাংক থেকেও তারা পরিচালক পদ হারিয়েছেন। একসঙ্গে চার পরিচালক হারিয়েছে পদ্মা ব্যাংক। এখন ব্যাংকটি পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকও করতে পারছে না।
ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে টানা ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন দুঃশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটে। সরকার পরিবর্তনের পর আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি সবমহলেই বিগত আওয়ামী লীগের সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর তার নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে সমস্যায় ব্যাংকটিতে এখন তৈরি হয়েছে তারল্য সংকট।
জানা গেছে, জুলাই মাসের শেষ দিকে নামে বেনামে এক্সিম ব্যাংক থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা তুলে নেন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধিতা করার দায়ে যাত্রাবাড়ী থানায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকের (বিএবি) সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। সেই মামলায় তাকে আটক দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে নতুন গভর্নর হিসেবে আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১ ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে পর্ষদ পুনর্গঠন করে। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকও রয়েছে। নতুন পরিচালনা পর্ষদদের সদস্যরা ব্যাংকের নানা সমস্যা তুলে ধরেন গভর্নরের কাছে। চান তারল্য সহায়তা। ইতোমধ্যে অর্থ সহায়তা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এসআই/পিএইচ