বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকে ১৬ বছর চাকরি করেছেন আফজাল করিম (ছদ্মনাম)। হঠাৎ এইচআরডি (মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগ) থেকে ডেকে বলা হলো, ‘আপনাকে পদত্যাগ করতে হবে।’ কেন পদত্যাগ করতে হবে জানতে চাইলে বলা হলো, ‘তেমন কিছু জানি না। ওপর থেকে নির্দেশ করেছেন স্যাররা। সিদ্ধান্ত হয়েছে যাদের বেতন বেশি তাদের মধ্যে ব্যাংক কিছু কর্মী ছাঁটাই করবে।’

যাদের নাম লিস্টে আছে তাদের পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে, যদি কেউ পদত্যাগ না করে তাকে টার্মিনেট করা হবে। আর যদি কাউকে টার্মিনেট করা হয় তাহলে সে আর অন্য কোনো ব্যাংকে চাকরি পাবে না। এমন হুমকি দিয়ে গত তিন বছরে শুধু আফজাল করিমকে নয়, শত শত কর্মীকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি ঢাকা পোস্টের হাতে আছে।  

ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ২০২১ সালে ৭২০ জন, ২০২২ সালে ৯৯৮ জন, ২০২৩ সালে ৮৩৫ জনসহ তিন বছরে মোট ২ হাজার ৫৫৩ জন চাকরি ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে নিজে থেকে পদত্যাগ করেছেন ২৪১৮ জন, টার্মিনেট হয়েছেন ৮৮ জন এবং ডিসমিস করা হয়েছে ৪৭ জনকে।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম তদন্ত করে জানতে পারে, যারা নিজ থেকে পদত্যাগ করেছেন বলে ব্র্যাক ব্যাংক দাবি করছে তাদের বেশিরভাগকেই জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। যদি তারা পদত্যাগ না করে তাহলে টার্মিনেট করা হবে। কাউকে টার্মিনেট করলে পরবর্তীতে অন্য ব্যাংকে সাধারণত চাকরি হয় না। এই ভয়ে বেশিরভাগ পদত্যাগ করেছেন।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ভঙ্গ করে দেড় হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তিন বছরের বেশি সময় একই শাখায় ও বিভাগে বহাল রেখেছে। আবার একই বিভাগে ৮ থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত বহাল রাখারও নজির রয়েছে।

বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করার ক্ষেত্রে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে— এমন কথা জানিয়ে গত ১২ আগস্ট ব্যাংকের এমডিকে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চিঠিতে বলা হয়, ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরিচ্যুতি ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ব্যাখ্যা চেয়েছিল তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। পাশাপাশি ব্যাংকটি চাকরির নিয়োগ বিধান পরিপালনে স্পষ্টতই অনীহা প্রকাশ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ২৯ আগস্টের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যতিরেকে জোরপূর্বক চাকরিচ্যুতির শিকার কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করতে বলা হয়। একই সঙ্গে প্রতি তিনমাস পরপর চাকুরিচ্যুতির ও স্বেচ্ছা পদত্যাগের তথ্য প্রতিবেদন আকারে পাঠাতে হবে এবং কর্মকর্তাদের নিয়মিত বদলি সংক্রান্ত নির্দেশনা পরিপালন করতে বলা হয়।  

জোরপূর্বক চাকরিচ্যুতিসহ এসব বিষয়ে জানতে দুসপ্তাহ আগে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে লিখিত প্রশ্ন করা হলেও কোনো উত্তর দেননি তিনি। আজ তার নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি।  

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, টানা চার বছর ধরে সর্বোচ্চ পারফর্মার হওয়ার পরও শুধুমাত্র এক বছর নন-পারফর্মার হিসেবে মূল্যায়ন করে চাকরি হতে অপসারণ করা হয়েছে, যা অগ্রহণযোগ্য। পারফর্মেন্স মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিভাগ ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে, যার কোনোটিরই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

এ ছাড়া ব্যাংকটির সব স্থায়ী কর্মকর্তারা একক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মূল্যায়িত হন না। আবার বিভিন্ন বিভাগের পারর্ফম্যান্স মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রধানের পছন্দ বা অপছন্দের প্রয়োগ হয়ে থাকে। তাছাড়া ব্যাংকটির মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পাশপাশি বিভাগভিত্তিক আলাদা মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকায় বিভাগ প্রধানের আলাদা ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে, যা ব্যাংকটির সার্বিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে বিশৃঙ্খল এবং অকার্যকর করে তুলছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নন-পারর্ফমার হিসেবে মূল্যায়িতদের চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে টার্মিনেট করার হুমকি দেওয়া হয়। ব্যাংকটির চাকরিচ্যুতির পরিসংখ্যানেও এই অভিযোগ প্রমাণ হয়। টার্মিনেট হলে অন্য কোথাও চাকরি হবে না, এই ভয়ে অনেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগে বাধ্য হন।

এদিকে ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করা কিছু কর্মকর্তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের জানান, তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। অন্যদিকে ছাঁটাই, অপসারণ ও বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। কারণ দর্শানো নোটিশ বা আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি।

ব্যাংকারদের চাকরি সুরক্ষায় কারণ ছাড়াই ছাঁটাই বন্ধে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নির্দেশনায় বলা হয়, সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত অভিযোগ ছাড়া কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। পাশাপাশি মহামারি কোভিডকালীন ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের যে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও চাকরিচ্যুত হয়েছেন কিংবা চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের (আবেদনপ্রাপ্তি সাপেক্ষে) বিধি মোতাবেক চাকরিতে বহালের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এসআই/এনএফ