ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে টানা ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন দুঃশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটে। এরপর একে একে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবাজ ও দলীয় কোটায় নিয়োগ-প্রমোশনপ্রাপ্তদের পদত্যাগের দাবিতে শুরু হয় বিক্ষোভ। বাদ যায়নি ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংকও।

বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নর। তারা হলেন– কাজী সাইদুর রহমান, খুরশীদ আলম, হাবিবুর রহমান এবং নুরুন নাহার। এর মধ্যে কাজী সাইদুর রহমান ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সাদা কাগজে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন। আর সরকারের পতনের চার দিনের মাথায় পদত্যাগ করেন ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বাকিরা পদত্যাগ করবেন জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ত্যাগ করেন।

এ ছাড়া, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস এবং নীতি উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাসেরকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিক্ষোভকারী কর্মকর্তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গভর্নরের পদত্যাগের পর ব্যাংকের হাল ধরেন ডেপুটি গভর্নররা। এখন চার ডেপুটি গভর্নরও বিক্ষোভকারীদের কাছে লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে পুরোপুরি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

দেশ স্বাধীনের পর এবারই প্রথম কেন্দ্রীয়  ব্যাংকে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, আর্থিক দুর্নীতি ও অর্থপাচার এবং দখলদারদের বিতাড়িত করতে বিক্ষোভ হচ্ছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে। ১৬ বছর ব্যাংক খাতে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের নজিরবিহীন স্বেচ্ছাচারিতার লুটপাটের অবসান চাচ্ছে সবাই। নামে-বেনামে ঋণ দিয়ে তা পাচারে সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা, অবৈধ নিয়োগ বাতিল, জোর করে চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে কয়েকটি ব্যাংকের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন অনিয়ম, দুর্নীতি, দখলদার আর ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে পুরো আর্থিক খাতে ভঙ্গুর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ সব অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিতাড়িত করে, দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের ব্যাংক খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। তবে পুরো ব্যাংক খাত একসঙ্গে সংস্কার করা যাবে না। কিছু কাজ করতে সময় লাগবে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসনিক কাঠামো দ্রুত পুনর্গঠন করতে হবে। কারণ, এখানে এখন কেউ নেই। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে অরাজকতা বন্ধ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া দরকার। তা না হলে অর্থনীতি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ কাজে আসবে না। এ ছাড়া, গত কয়েক দিনে বিভিন্ন ব্যাংকে মালিকানা নিয়ে বিক্ষোভ, আন্দোলন ও নিয়ন্ত্রণ নেওয়াসহ যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এই মুহূর্তে ব্যাংক থেকে যেন কেউ টাকা নিয়ে চলে যেতে না পারে, তাও ঠেকাতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার শপথ নেওয়ার পর শনিবার সচিবালয়ে প্রথম অফিস করেন। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আর্থিক খাতে যারা কেলেঙ্কারি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চেষ্টা করার কথা জানিয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। এ মুহূর্তে মূল কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা। আইনশৃঙ্খলা মানে শুধু রাস্তাঘাটের আইনশৃঙ্খলা নয় বরং ব্যাংক, ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্দর ইত্যাদি চালু করা।

সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কিছু কিছু লোক সিলেক্টেড, তারাই খালি তোষামোদ করে। আপনারা একটু প্রো-অ্যাকটিভ হবেন। আমাদের সাজেশন দেবেন। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলাম, যখনই কিছু বলতাম বলত স্যার আমরা সব করে ফেলব। এ রকম রিঅ্যাকটিভ হলে তো কাজ হবে না।

ব্যাংকে ব্যাংকে বিক্ষোভ

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কিছু ব্যাংকে পাল্টা নিয়ন্ত্রণ ও দখলদারদের বিতাড়িত করার মিশন শুরু হয়।  ছাত্র অভ্যুত্থানের পর গত মঙ্গলবার প্রথম কর্মদিবসেই ইসলামী ব্যাংকের এক্সিকিউটিভসহ (নির্বাহী কর্মকর্তারা) যারা অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের নিয়োগ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখলের পর এসব নির্বাহী কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় এস আলম গ্রুপের নির্দেশে নিয়োগপ্রাপ্ত বলে দাবি কর্মকর্তাদের।

গত মঙ্গলবার থেকে এসব দাবি করে আসছেন ইসলামী ব্যাংকের সিবিএ নেতারা। পরে বুধবার এস আলমের আমলে পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কায়সার আলী ব্যাংকে এলে তাকে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। শুধু তাই নয়, বৃহস্পতিবার রাজধানীর দিলকুশায় ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে কয়েকজনকে মারধর করে বের করে দিতে দেখা গেছে।

এর আগে ব্যাংকের আরেক ডিএমডি (উপ-মহাব্যবস্থাপক) রেজাউর রহমানকে মারধর করেছে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ ছাড়া, এস আলমের ‘বিশেষ কৃপায়’ প্রমোশন পাওয়া আরও অন্তত চার থেকে পাঁচজনকে মারধর করেছেন তারা।

কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক খাতের ভঙ্গুরতার কারণে দেশের অর্থনীতিতে আজ এই খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ কষ্টে আছে। তাই গভর্নরসহ বিভিন্ন অনিয়মে দায়ী কর্মকর্তা যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বিচার করতে হবে। এ ছাড়া, যেসব নির্বাহী পরিচালক অনিয়মে সহায়তা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাথমিকভাবে তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে।

ইউসিবিতে বিক্ষোভ

মালিকানা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছেন বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পারটেক্স গ্রুপের এম এ হাসেম পরিবার। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার কয়েকজন শেয়ারহোল্ডারের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও বিএসইসি চেয়ারম্যানের বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে ব্যাংকের আর্থিক খারাপ অবস্থার চিত্র তুলে ধরে অবিলম্বে মালিকানা বদল চাওয়া হয়।

এরপর বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) গুলশানে ইউসিবির প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ব্যাংকের দেড় শতাধিক শেয়ারধারী। ওই সময় তারা বিভিন্ন ফেস্টুন প্রদর্শন করে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থ পাচার’ ও ব্যাংকটির নানা অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করেন।

ইউসিবির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী। শুরু থেকে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম এ হাসেম। তারা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত উভয়ের পরিবারের সদস্যরাই ব্যাংকটিতে যুক্ত ছিলেন ও নেতৃত্ব দেন।

ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে পারটেক্স গ্রুপের মালিক পরিবারের সদস্যদের ইউসিবি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। ব্যাংকটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুকমিলা জামান। তবে রুকমিলা জামান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় ব্যাংকটি মূলত সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিচালনা করেন, এমনটাই জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ, ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকটিকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ‘অবাধ লুটপাট, আর্থিক দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার’ করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল এক হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সাল শেষে বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।

এদিকে, করোনা মহামারির সময় চাকুরিচ্যুত বেশ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তারা চাকরি ফেরত পেতে আইএফআইসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। এ সময় তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার ২১ বাস্তবায়ন করে তাদেরকে চাকুরিতে পুনর্বহাল করার দাবি জানান।

বাকি ব্যাংকগুলোর কী অবস্থা?

তারা জানান, সার্কুলার অনুযায়ী ব্যাংকের চাকুরিতে পুনর্বহালে আবেদন করলেও ব্যাংকগুলো তাদের পুনর্বহাল না করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর আবেদনসহ বিভিন্ন ব্যাংকের ৫০ জন ব্যাংক কর্মকর্তা একত্রে হাইকোর্টে রিট করেন। পরে হাইকোর্ট রুলের শুনানি শেষে মোট ৪৭ জন ব্যাংক কর্মকর্তাকে চাকুরিতে পুনর্বহালের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

বেসরকারি খাতের অন্যতম ন্যাশনাল ব্যাংকের মালিকানা সিকদার গ্রুপের হাত থেকে তুলে দেওয়া হয় এস আলম গ্রুপের হাতে। এই ব্যাংকটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিএনপির অন্যতম ব্যবসায়ী নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু। আওয়ামী লীগের সময় বিভিন্ন চাপে ব্যাংকটির মালিকানা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন মিন্টু। এখন আবার তারা মালিকানায় ফেরার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।

এ ছাড়া, সরকার পতনের পর বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চাকুরিচ্যুত কর্মকর্তাদের পুর্নবহাল, ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের একটি গ্রুপ, সিটি ব্যাংক ও মিচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে বিক্ষোভ করেছে কর্মকর্তারা। অসন্তোষ দেখা দিয়েছে ওয়ান ব্যাংকেও। বুধবার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেন।

এসআই/এমজে