দীর্ঘ দিন খোলাবাজারে ডলার বিক্রি করছেন কবির আহম্মেদ। বৃহস্পতিবার সকালে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো ডলারের রেট কত? জানতে চাইলেন কিনবেন না কি বিক্রি করবেন। কিনবো বললে, উত্তরে বলেন ডলার নেই, কেউ যদি বিক্রি করে তাহলে ১১৯ টাকা রেট দেব! কিনলে রেট কত? জানতে চাইলে বলেন ডলার নেই, রেট দেব কিভাবে?
 
এরপর মতিঝিল পাইওনিয়ার মানি এক্সচেঞ্জে গিয়ে আজকের ডলার বিক্রির রেট কত জানতে চাইলে? সেখানে দায়িত্বরত কর্মী জানান ডলার নেই, তাই রেট বলা যাচ্ছে না। কেউ বিক্রি করলে ১১৭ টাকা ২০ পয়সা পাবে। হঠাৎ ডলার না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাল বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম একবারে ৭ টাকা বাড়িয়েছে তাই এ অবস্থা হয়েছে।    

বৃহস্পতিবার (৯ মে) রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, বাইতুল মোকাররম গুলশান ও বনানীর এলাকায় খোলাবাজারে ডলার ব্যবসায়ী ও মানি এক্সচেঞ্জের কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের দাম একদিনে ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এখন আনুষ্ঠানিক ডলার রেট ১১৭ টাকা; যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ দর। নিময় অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ১১৮ টাকা বিক্রি করতে পারবে। হঠাৎ করে দাম বেড়ে যাওয়ায় মানি চেঞ্জারগুলো ডলার বিক্রি করছে না। আবার যাদের কাছে খুচরা ডলার আছে তারাও বিক্রি না করে রেখে দিয়েছেন। কারণ যেহেতু আনুষ্ঠানিক ডলার রেট ৭ টাকা বেড়েছে খোলাবাজারে কত বাড়ে তা দেখার অপেক্ষায় আছেন সবাই। এমন পরিস্থিতির কারণে খোলাবাজারে বিক্রি শূন্য হয়ে গেছে ডলার।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের খুচরা ডলার পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ ঠিক আছে। এখনে কে বিক্রি করবে কি করবে না এটা তার নিজস্ব বিষয়। যারা মানি এক্সচেঞ্জে ডলার পায়নি তারা ব্যাংকে গেলেই ডলার কিনতে পারবেন। ব্যাংকে এখন ৫০ মিলিয়ন বা ৫ কোটি ক্যাশ ডলার মজুদ আছে। যার ডলার দরকার ব্যাংকে গেলেই পাবেন।
 
থাইল্যান্ড চিকিৎসার জন্য যাবেন মাহফুজুর রহমান, মতিঝিল এসেছেন খুচরা ডলার কিনতে। তিনি বলেন, আগামী রোববার থাইল্যান্ড যাবো। আজকে ৫০০ ডলার কিনতে এসেছি। কমপক্ষে ৬টি মানি এক্সচেঞ্জে ঘুরলাম কেউ ডলার বিক্রি করলো না। এখানে এক্সিম ও অগ্রণী ব্যাংকে গেলাম ভিসা পাসপোর্ট দেখালাম-তারপরও বলল সরাসরি ডলার দেওয়া যাবে না। পরে ইউসিবির এক পরিচিত ব্যাংকারকে ফোন দিলাম, বলল অ্যাকাউন্ট না থাকলে সহজে ডলার বিক্রি করতে চায় না ব্যাংক। এরপরও যেতে বলল কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখবে।

তবে সরকারি বেসরকারি বেশ কয়েকটি ব্যাংকে ট্রাজারি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যেসব শাখায় ডলার আছে তারা খুচরা ডলার বিক্রি করছে। তবে যে কেউ গেলেই ডলার পাবে না- নিজস্ব ও পরিচিত গ্রাহককেই শাখাগুলো ডলার দিচ্ছি। আজকে বেশিরভাগ ব্যাংক খুচরা প্রতি মার্কিন ডলার বিক্রি করছে ১১৮ টাকায়।  

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তে দীর্ঘদিন ১১০ টাকায় বেধে রাখার পর বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের অফিসিয়াল রেট একদিনে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকায় উন্নীত করেছে। এর ফলে ডলারের সঙ্গে টাকার বড় অবমূল্যায়ন করা হয়।

এ বিষয় সার্কুলার জারি করে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করার কথা জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই পদ্ধতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতির আওতায় ডলারের মধ্যবর্তী একটি দাম নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে এই দরের আশপাশে স্বাধীনভাবে লেনদেন করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মধ্যবর্তী এই দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা।

ব্যাংকাররা জানান, এতদিন ১১০ টাকা ডলার রেট বেধে দেওয়া থাকলে ১১৭-১১৮ টাকার মধ্যে ডলার কেনাবেচা হয়েছে। যদিও নথিপত্রে দেখানো হয়েছে ১১০ টাকা। নতুন ঘোষণায় বিদেশে থাকা অর্থ স্থানান্তর প্রতিষ্ঠানগুলো ডলারের দাম বাড়িয়ে দেবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

দেশে ডলারের সংকট চলছে। ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছে। এতে করে বেড়েছে আমদানি করা পণ্যের দাম, ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দীর্ঘদিন ধরে ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। 

তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ঋণের সুদ ও ডলারের দাম বাড়লে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করবে।

এতদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে আমদানি ও রপ্তানি থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকের কাছে কত দরে ডলার কেনা-বেচা করা হবে, তা ঠিক করত বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। এখন থেকে ডলারের দাম নির্ধারণে বাফেদা বা এবিবির কার্যত কোনো ভূমিকা থাকবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদন করে। এসময় কিছু নীতি সংস্কারসহ বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়। ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর দুই কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি পেয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় কিস্তিতে ৭০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা আগামী মাসে। তার আগে পর্যালোচনা বৈঠক করতে ঢাকায় আসে আইএমএফের ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল।

আইএমএফ বুধবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, দুর্বল অবস্থা থেকে ব্যাংক খাতকে টেনে তুলতে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তারা জানান সরকারের উচিৎ হবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার যথাযথ কৌশল তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করা। 

সংস্থাটি আরও জানায়, টেকসই আর্থিক খাত তৈরির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিৎ হবে চলমান ঝুঁকি ভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থার কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি করপোরেট সুশাসনের উন্নয়ন ও আইনি কাঠামোর সংস্কার করা দরকার।

এসআই/এমএসএ