মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি)। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে এত বড় একটি ব্যাংকের পতন যা নিয়ে পৃথিবীজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কী ঘটেছিল যে একটি ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হলো? বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে এমন ঘটনা ঘটবে কি-না এ নিয়ে চলছে নানা অলোচনা-সমালোচনা।
 
কি ঘটেছিল এসভিবিতে?

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েকটি কারণে এসভিবি এ অবস্থায় পড়েছে। তার মধ্যে অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা নীতি সুদহার এবং গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি।

ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার এসভিপির সবগুলো শাখায় মোট ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি পরিমাণ অর্থ ছিল। কিন্তু গ্রাহকদের প্রায় সবাই টাকা তুলে নেওয়ার পর এখন অবশিষ্ট ছিল মাত্র ৯৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এমন পরিস্থিতি দেখে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বন্ধ করে দেয়। এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার হাতে চলে গেছে ব্যাংকের সব আমানতের দায়

বিভিন্ন মাধ্যম বলছে, মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্যাংকটির একদম বন্ধ হয়ে পড়ার মূল কারণ গুজব। গেল বুধবার হঠাৎ শোনা যায়, গুরুতর আর্থিক ঘাটতিতে ভুগছে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। ঘাটতির পরিমাণ এতটাই যে, ব্যাংকের ব্যাল্যান্স শিটের কিনারা করতেই প্রয়োজন অন্তত ২২৫ কোটি ডলার। শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেয় ব্যাংকটি। এতে গ্রাহকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ গুজব ছড়িয়ে পড়তেই সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যায়। বুধবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার পর্যন্ত হাজার হাজার গ্রাহক ব্যাংক থেকে তাদের টাকা তুলে নেন।

>> মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ধস নামল যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকে

ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার এসভিপির সবগুলো শাখায় মোট ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি পরিমাণ অর্থ ছিল। কিন্তু গ্রাহকদের প্রায় সবাই টাকা তুলে নেওয়ার পর এখন অবশিষ্ট ছিল মাত্র ৯৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এমন পরিস্থিতি দেখে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বন্ধ করে দেয়। এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার হাতে চলে গেছে ব্যাংকের সব আমানতের দায়।

যেভাবে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়

যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণের বিপরীতে সুদের হার বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছিল দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম। এরপর সুদের হার বাড়ায় অনেক স্টার্টআপ শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলতে পারেনি। ব্যক্তি খাত থেকে অর্থ নেওয়াও তাদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের অনেক গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে তাদের নগদ অর্থের চাহিদা পূরণ করা শুরু করে।

তহবিলের ঘাটতি মেটাতে এসভিবি বৃহস্পতিবার জানায় যে তারা ২২৫ কোটি ডলারের সাধারণ সম্পদ বিক্রি করবে। এই খবরে এক দিনে ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৬০ শতাংশ পড়ে যায়। এতে বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আমানতকারীরা অর্থ উত্তোলন করতে থাকেন

সংকটে পড়ে দায় মেটানোর অর্থ জোগাড় করতে ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার মূল্যের বন্ড বিক্রি করে, যেসব বন্ডের বেশির ভাগ ছিল ইউএস ট্রেজারি বন্ড। এই বন্ডে তারা সুদ পাচ্ছিল গড়ে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যদিও ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের বর্তমান সুদহার কমবেশি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এ কারণে এসভিবিকে ১৮০ কোটি ডলার লোকসানে পড়তে হয়। এই ঘাটতি পূরণ করতে তার পুঁজি বাড়ানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তহবিলের ঘাটতি মেটাতে এসভিবি বৃহস্পতিবার জানায় যে তারা ২২৫ কোটি ডলারের সাধারণ সম্পদ বিক্রি করবে। এই খবরে এক দিনে ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৬০ শতাংশ পড়ে যায়। এতে বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আমানতকারীরা অর্থ উত্তোলন করতে থাকেন।

দেশে এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা আছে কি?

যুক্তরাষ্ট্রের মত এতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে গুজবের কারণে একটি ব্যাংকের পতন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা কি? এমন পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা? হলে কীভাবে মোকাবিলা করবে- এসব বিষয় জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশে যেসব ব্যাংক আর্থিক সমস্যায় আছে তার বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থাৎ সরকারের মালিকানাধীন। এসব ব্যাংকে সংকট হলে সরকার সহায়তা দেবে। এটা নিয়ে খুব একটা চিন্তা বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। বেসরকারি খাতে কিছু ব্যাংকের সমস্যা আছে; তবে আমাদের যেটা করতে হবে তা হলো- এই দৃষ্টান্ত থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক হতে হবে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রস্তুত থাকতে হবে।

তিনি বলেন, এখন থেকে জানতে হবে কোথায় কি সমস্যা আছে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে, আদায় বাড়াতে হবে। খেলাপি ঋণ না কমালে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হতে থাকবে। মূলধন ঘাটতি হবে তারল্য সংকটে পড়বে। আর যখন অর্থ সংকট দেখা দেবে তখন গ্রাহকের আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে।

>> যে কারণে বন্ধ হলো সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক

বাংলাদেশে এর কোনো প্রভাব পড়বে কি-না জানতে চাইলে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যেহেতু তাদের সঙ্গে এ দেশে সরাসরি কোনো ব্যবসা নেই তাই প্রভাব পড়ার শঙ্কাও নেই। তবে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্ক হতে হবে বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।

ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগামীতে কেমন পরিস্থিতি হবে তা এখন বলা কঠিন। সংকটে পড়া ব্যাংককে সহযোগিতা করতে তাদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা একভাবে কাজ করে আমাদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা অন্যভাবে কাজ করে। তাই এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে ঘটার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতীতে সংকটে পড়া ব্যাংককে সহযোগিতার দৃষ্টান্ত আছে।

>> সোনালী ব্যাংকের নাম পরিবর্তন

দুই দেশের নীতি ভিন্ন এছাড়া বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো। তাই দেশের কোনো ব্যাংকের এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং সিস্টেম তাদের নিয়মে চলে, আমাদের ব্যাংকিং সিস্টেম আমাদের নিয়মে। আমাদের এ ধরনের পরিস্থিতি হবে না। আর হলেও উত্তরণে যা করণীয় আমরা তা করব। তবে আমরা বলতে পারি, দেশের ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা খুবই শক্ত। কোনো কিছু হলেই যে তাদের দেউলিয়া হতে হবে এমন কোনো পরিস্থিতি এখানে নেই।

তিনি বলেন, অতীতে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে দেশের ব্যাংকের পরিস্থিতি ঘোলাটে করার একটা চেষ্টা হয়েছিল; কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ায় ওই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসি। আমরা সব সময় যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত আছি। তবে এমন অবস্থার সম্মুখীন আমাদের হতে হবে না বলে জানান আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার এ মুখপাত্র।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। যাদের প্রভিশন ঘাটতি থাকে নিয়ম অনুযায়ী তারা লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। আবার যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে করে ব্যাংকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পরবে। আমানতকারীদের অর্থের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে

এদিকে বিশেষ ছাড় দিয়ে গত বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমানো হয়। কিন্তু কাগজে কলমে মন্দ ঋণ কম দেখালেও এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয় সরকারি-বেসরকারি খাতের ৮ ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক, অগ্রণী, রূপালী, বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এবং বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৬ কোটি টাকা।

>> ফেব্রুয়া‌রিতে রে‌মিট্যান্স এলো ১৫৬ কো‌টি ডলা‌র

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। যাদের প্রভিশন ঘাটতি থাকে নিয়ম অনুযায়ী তারা লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। আবার যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে করে ব্যাংকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পরবে। আমানতকারীদের অর্থের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে।

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক

১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক, শুরুতে এটির নাম ছিল ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাংক। যাত্রা শুরুর পর গত দশকে ব্যাংকটির বিস্তার ঘটে সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও বাইরের বিভিন্ন দেশে ৮ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি কর্মী আছে এসভিবির। এই কর্মীদের অধিকাংশই অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখার।

বর্তমান পরিস্থিতিতে এসভিবির এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া অবশ্য মার্কিন অর্থনীতির জন্য অশুভ সংকেত। কারণ গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশটিতে লাগামহীন ভাবে বাড়ছে ডলারের মান। ফলে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে

২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক মন্দা শুরু হয়েছিল। সে সময় দেশটির ছোট-বড় অনেক ব্যাংক একের পর এক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। সেই মন্দা পরিস্থিতির ১৫ বছর পর এই প্রথম শীর্ষস্থানীয় কোনো ব্যাংকের এমন আকস্মিক পরিস্থিতি ঘটল যুক্তরাষ্ট্রে। শুধু তা–ই নয়, এটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক ধস।

বর্তমান পরিস্থিতিতে এসভিবির এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া অবশ্য মার্কিন অর্থনীতির জন্য অশুভ সংকেত। কারণ গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশটিতে লাগামহীন ভাবে বাড়ছে ডলারের মান। ফলে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে।

এসআই/ওএফ