খেলাপি ঋণ নিয়ে আইএমএফের ‘তোপের মুখে’ বাংলাদেশ ব্যাংক
অনেক গ্রাহক যেমন ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না তেমনি বিভিন্ন পক্ষের তদবিরে বা যোগসাজশে দেওয়া ঋণ আদায়ও করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ফলে খেলাপি ঋণে হাবুডুবু খাচ্ছে দেশের ব্যাংক খাত।
বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। কেন খেলাপি বাড়ছে, খেলাপি কমাতে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিংবা খেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে কি না- এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।
বিজ্ঞাপন
রোববার (৩০ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। বৈঠকে খেলাপি ঋণের বিষয়ে উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি প্রতিকারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে চলমান আলোচনার অংশ হিসেবে এসব বৈঠক করছে আইএমএফ।
আরও পড়ুন : আইএমএফের ঋণ : জ্বলছে কি জ্বালানি বাজার?
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয় বলে ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই হার প্রায় ৯ শতাংশ। সরকারি ব্যাংকে এই হার ২০ শতাংশের বেশি। এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। একইসঙ্গে সন্দেহজনক লেনদেন ও অর্থপাচার নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এছাড়া সুশাসনের ঘাটতির কারণে আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকা বেনামি ঋণও নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করবে বলে মনে করছে তারা।
সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে বিপদগ্রস্ত ঋণের অঙ্ক কত— তা জানতে চাওয়া হয়েছে আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
এর আগে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কয়েকটি সেশনে বৈঠক করে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। প্রথম পর্বের বৈঠকে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহ আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর ওইদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে বসে প্রতিনিধিদল। এ সময় রিজার্ভসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা এবং বাজেট সহায়তা হিসেবে আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণ নিতে চাচ্ছে সরকার। এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ), এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাস্টেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) কর্মসূচির আওতায় তিন কিস্তিতে দেড় বিলিয়ন করে এই ঋণ পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী সরকার।
আরও পড়ুন : বৈশ্বিক মন্দা ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি
ঋণের বিষয়ে আলোচনা করতেই গত বুধবার ১৫ দিনের সফরে ঢাকায় আসে আইএমএফের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল।
তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ঋণের বিষয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যেই নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানানো হয়।
খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি
বিভিন্ন ধরনের ছাড় প্রদান এবং করোনা পরিস্থিতি উন্নতির পরও দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২২ সালের জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৫৫ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের তথ্যে গোঁজামিল!
এদিকে খেলাপি ঋণের তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে আইএমএফসহ বিভিন্ন তরফ থেকে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাকে আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছে। তা না হলে ব্যাংকিং খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের সঠিক তথ্য প্রকাশের কথাও বলেছে সংস্থাটি। তাদের মতে, খেলাপি ঋণের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।
আরও পড়ুন : স্ট্যাগফ্লেশন : বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে?
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, খেলাপি ঋণের হিসাব দুভাবে করা হয়। একটি গ্রস, অপরটি নিট। গ্রস হিসাবে খেলাপি ঋণ বেশি হলেও নিট হিসাবে কম। এই হার ৩-৪ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। করোনার কারণে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানায়, বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারি ব্যাংকে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে নেই। ফলে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ কী
এর আগের বৈঠকে আইএমএফ মিশনের কার্যক্রম ও পরিকল্পনা নিয়ে ৩০ মিনিটের একটি উপস্থাপনা তুলে ধরা হয়, যেখানে আইএমএফের ঋণের বিষয়টিও উঠে আসে। এ সময় রিজার্ভ সাশ্রয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপ এবং রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি পরিবর্তনের অগ্রগতি জানতে চায় প্রতিনিধি দলটি। এ ছাড়া সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ, বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন, সঞ্চয়পত্র খাতের সংস্কার, ঋণের সুদের হারসহ মুদ্রানীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়।
আরও পড়ুন : সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি!
আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার কয়েক দফা কমানোর পরও ঋণের সুদের সীমা দিয়ে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এতে প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। তাই অর্থনীতির স্বার্থেই নীতি সুদহার তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেয় আইএমএফ। এ ছাড়া বৈঠকে টানা ডলার বিক্রির কারণে অব্যাহতভাবে দেশের রিজার্ভ কমে যাওয়া নিয়েও সংস্থাটির পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। আইএমএফ বলছে, এভাবে রিজার্ভ কমতে থাকলে তা দেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের চাপের মুখে ফেলতে পারে।
আরেক বৈঠকে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য ও বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এ ছাড়া বহিঃখাতের ঋণপ্রবাহ এবং আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং রপ্তানি খাত ও বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ পরিস্থিতিও জানতে চাওয়া হয়।
নতুন করে রিজার্ভ হিসাব চূড়ান্ত!
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইএমএফের প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়, তাদের ম্যানুয়াল অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন : বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং বাংলাদেশ
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে আগে থেকেই আপত্তি রয়েছে আইএমএফের। সংস্থাটির ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, কোনো দায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে না। বিশেষ করে রিজার্ভের অর্থে গঠিত ইডিএফসহ বিভিন্ন ঋণ তহবিল, যা নন লিকুইড সম্পদ, তা রিজার্ভ থেকে বাদ দিয়ে হিসাব করার কথা বলে আসছে আইএমএফ।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হিসাব করলে এটি কমে দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে মাত্র সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ।
এসআই/আরএইচ