নিম্নমুখী ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৪ টাকায়
মার্কিন ডলারের সংকট কাটাতে বিলাসী পণ্যসহ আমদানিতে নানা শর্ত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে কমেছে আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ। যার প্রভাব পড়ছে ডলারের বাজারে।
মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে নগদ ডলারের দাম বিক্রি হচ্ছে ১১৪ থেকে ১১৫ টাকায়। গত সপ্তাহেও এক ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুণতে হয়েছিল ১১৮ থেকে ১২০ টাকা।
বিজ্ঞাপন
মতিঝিল দিলকুশার এলাকায় খুচরা ডলার কেনা-বেচা করেন সালাউদ্দিন। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, চলতি সপ্তাহের শুরু থেকেই বাজার একটু কমার দিকে। হঠাৎ বাড়ে-কমে এখন বাজারের অবস্থা বলা মুশকিল। সকালে ১১৪ টাকায় কিনেছি, বাজার পড়ে গেছে। আবার ১১৪ টাকায় বিক্রি করলাম। এখন আবার ১১২ টাকা ৫০ পয়সা, ১১৩ টাকা এ রেটে কিনছি। বিক্রি করছি ১১৪/১১৫ টাকায়। বিকেলের বাজারের রেট কী হবে বলতে পারবো না।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সংস্থার লোকজন হঠাৎ অভিযান করে। এখন খুব ভয়ে ভয়ে ব্যবসা করতে হয়। তাই ডলার কিনে রাখার পরিস্থিতি নেই। নগদে যা পাই তাই কেনাবেচা করি।
গুলশানের মানি চেঞ্জারের কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, আজকে ডলারের কেউ বিক্রি করতে এলে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৩ টাকায় কিনছি। আর কেউ নগদ ডলার কিনতে এলে ১১৪ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি করছি। গত দু-তিন দিন ধরে বাজার একই অবস্থা যাচ্ছে। আগামীকাল বাজারের অবস্থা কী হবে বলতে পারবো না।
এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হয়েছে ৯৫ টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি আমদানি বিল মেটাতে এই দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। নিয়ম অনুযায়ী এটাই ডলারের আনুষ্ঠানিক দর। চলতি বছরের মে মাসের শুরুর দিকে এ দর ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায়। এ হিসাবে দেড় মাসের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ৮ টাকা ৫৫ পয়সা।
তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও এখন ১০৬ থেকে ১০৮ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি হচ্ছে। আর খোলাবাজারে ডলারের দাম ১১৫ টাকা পর্যন্ত। এর আগে দেশে খোলাবাজারে প্রথমবারের মতো ১০০ টাকার ঘর পেরিয়ে যায় গত ১৭ মে। এরপর আবার কমে আসে। পরে গত ১৭ জুলাই ফের ১০০ টাকা অতিক্রম করে। গত ১০ ও ১১ আগস্ট নগদ ডলার ১২০ টাকায় উঠেছিল।
আমদানির চাপে দেশে মার্কিন ডলারের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর সুবিধা নিচ্ছে কিছু ব্যাংক। রপ্তানির বিলে ডলারের রেট কম দিচ্ছে। অন্যদিকে আমদানির বেশি দাম নিচ্ছে এলসিতে। অনেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ডলার মজুত করে হাতিয়ে নিয়েছে বড় অংকের মুনাফা। ৯৬ থেকে ৯৮ টাকা ডলারের রেট রপ্তানিতে দিয়ে ১০৬ থেকে ১০৯ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে আমদানি এলসিতে। কোনো কোনো ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ৪২৫ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করছে। এমন মনোভাব দেশ ও অর্থনীতির জন্য শুভকর নয়। এভাবে চলতে থাকলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।
এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ডলার বিক্রিতে মুনাফার হার নির্ধারণ করে দেওয়া। যাতে করে ব্যাংকগুলো এমন অনৈতিক কাজ না করতে পারে।
এদিকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করার প্রমাণ পাওয়ায় গত ৮ আগস্ট দেশি-বিদেশি ৬টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণ করতে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো- বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। জানা গেছে এসব ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ৪৫০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে।
অন্যদিকে ডলার বাজার স্থিতিশীল করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বৈঠক শেষে ডলারের বাড়তি মুনাফার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, এখন ডলারের টানাপড়েন চলছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাফেদা ও বাংলাদেশ ব্যাংক বৈঠক করেছে। ডলারের মার্কেট যাতে খুব কম সময়ের মধ্যে স্থিতিশীল করা যায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
ব্যাংকগুলো আমদানির রেটের চেয়ে রপ্তানিতে ডলারের মূল্য অনেক কম দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, আমরা নিয়মিত বাজার পরিদর্শন করছি। এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো যে রেটে রপ্তানির ডলার কেনে, পরে আমদানি এলসির করার সময় সেই রেটের ব্যবধান যেন বেশি না হয়। এজন্য একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে মুনাফা করতে বলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব শেষ তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসের ১১ দিনে দেশে মোট ১৬১ কোটি ডলার সমপরিমাণ মূল্যের আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। যা জুলাই মাসের তুলনায় ৯৪ কোটি ডলার বা ৩৬ শতাংশ কম। জালাই মাসে আমদানি হয়েছিল ২৫৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য বলছে, গেল জুলাই মাসে দেশে মোট ৫৫৫ কোটি ডলার মূল্যের পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা জুন মাসের তুলনায় ৩০ দশমিক ২০ শতাংশ কম। জুন মাসে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৭৯৬ কোটি ডলারের। তবে জুন মাসে অবশ্য মে মাসের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র ৭ শতাংশ বেশি খোলা হয়েছিল। মে মাসে ঋণপত্র খোলা হয় ৭৪৪ কোটি ডলারের।
এপ্রিল মাস থেকে আমদানি কমতে শুরু করে। এপ্রিল মাসে মার্চের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। মে মাসেও এপ্রিলের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশ।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য অনেক বেড়ে যায়। ফলে বিগত কয়েক মাস ধরে আমদানি ব্যয়ে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ঠিক রাখতে গিয়ে প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। গত বছর আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে।
১২ আগস্ট পর্যন্ত রিজার্ভ দাঁড়ায় তিন হাজার ৯৫৯ কোটি (৩৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন) ডলারে। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে মজুদ এ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে রাশ টানার উদ্যোগ শুরু হয় গত মে মাস থেকে। তবে ৪ জুলাই এ ক্ষেত্রে বেশ কঠোরতা আরোপ করা হয়। গাড়ি, স্বর্ণ, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানির এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে শতভাগ। আর জ্বালানি, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, শিল্পে ব্যবহারি কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ কিছু পণ্য বাদে অন্য সব ক্ষেত্রে এলসি মার্জিনের ন্যূনতম হার হবে ৭৫ শতাংশ। উভয় ক্ষেত্রে মার্জিনের জন্য ঋণ দেওয়া যাবে না। এর মানে এলসি খোলার সময়ই আমদানিকারকের নিজস্ব উৎস থেকে পুরো অর্থ নগদে দিতে হবে।
চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ১০ দিনে ৮১ কোটি ৩০ লাখ (৮১৩ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৯৬ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ৭ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে মাসের শেষে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ২৪৩ কোটি ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
এসআই/এসএম