আমদানির চাপে দেশে মার্কিন ডলারের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর সুবিধা নিচ্ছে কিছু ব্যাংক। রপ্তানির বিলে ডলারের রেট কম দিচ্ছে। অন্যদিকে আমদানির বেশি দাম নিচ্ছে এলসিতে। অনেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ডলার মজুত করে হাতিয়ে নিয়েছে বড় অংকের মুনাফা। ৯৬ থেকে ৯৮ টাকা ডলারের রেট রপ্তানিতে দিয়ে ১০৬ থেকে ১০৯ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে আমদানি এলসিতে। কোনো কোনো ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ৪২৫ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করছে। এমন মনোভাব দেশ ও অর্থনীতির জন্য শুভকর নয়। এভাবে চলতে থাকলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।  

এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ডলার বিক্রিতে মুনাফার হার নির্ধারণ করে দেওয়া। যাতে করে ব্যাংকগুলো এমন অনৈতিক কাজ না করতে পারে।

রোববার (১৪ আগস্ট) এফবিসিসিআই কার্যালয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে এমন মন্তব্য করেছেন তারা। ‘বঙ্গবন্ধুর এসএমই উন্নয়ন ভাবনা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এ সেমিনারের আয়োজন করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।

সেমিনারের প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ব্যাংকগুলোর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শুধু ডলার বিক্রি করে লাভ করার জন্য এতগুলো ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এটা নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না।

মন্ত্রী বলেন, শুধু মুনাফা করাই ব্যাংকের কাজ নয়। তাদেরকে অবশ্যই জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেজন্যই তাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। নগরাঞ্চলে বড় গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে শহর-গ্রামের মধ্যে বৈষম্য বাড়ানো ব্যাংকের কাজ নয়। বরং উন্নয়ন সুষম করার দায়িত্ব।

ব্যাংকগুলোর ডলার নিয়ে ব্যবসা করার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এফবিসিসিআই’র সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রিতে মুনাফার হার নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। কোনো কোনো ব্যাংক ডলার বিক্রিতে ৪২৫ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করছে। এমন চললে দেশ গভীর সংকটে পড়বে।

সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই’র সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. মো. মাসুদুর রহমান, এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান। আরো উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি মো. আমিন হেলালী, মো. হাবীব উল্ল্যাহ ডনসহ পরিচালকরা। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন এফবিসিসিআই’র মহাসচিব মোহাম্মদ মাহফুজুল হক।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এফবিসিসিআই’র প্যানেল উপদেষ্টা ও সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এসএমই’র উন্নয়ন করে বৈষম্য কমিয়ে আনতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের বর্তমান ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের পেছনে এসএমই খাতের বিকাশ না হওয়াকে দায়ী করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি জানান, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দেশের এসএমই ঋণের সম্ভাব্য বাজার ২৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ কাঠামোতে এসএমই খাত অবহেলিত। তাই এই বিশাল লাভজনক খাতে ব্যাংকগুলো নজর দিচ্ছে না।

জানা গেছে, আমদানির চাপে দেশে মার্কিন ডলারের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বেড়েছে দাম, অন্যদিকে কমছে টাকার মান। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে নগদ ডলার ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠে।

এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারে কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৯৫ টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি আমদানি বিল মেটাতে এই দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। নিয়ম অনুযায়ী এটাই ডলারের আনুষ্ঠানিক দর। চলতি বছরের মে মাসের শুরুর দিকে এ দর ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায়। এ হিসাবে দেড় মাসের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ৮ টাকা ৫৫ পয়সা।

তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগু‌লো‌তেও এখন ১০৬ থে‌কে ১০৮ টাকায় নগদ ডলার বি‌ক্রি হচ্ছে।

এদিকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দাম বা‌ড়ি‌য়ে‌ বি‌ক্রি করার প্রমাণ পাওয়ায় গত ৮ আগস্ট দে‌শি-বি‌দে‌শি ৬টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভা‌গের প্রধানকে অপসারণ কর‌তে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো-বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, সি‌টি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশি খা‌তের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। জানা গেছে এসব ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ৪৫০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে।

অন্যদিকে ডলার বাজার স্থিতিশীল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আজ বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে বৈঠক করেছে।

এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, আহমেদ জামাল, একেএম সাজেদুর রহমান খান, আবু ফরাহ মো. নাছের, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিচালকরা। সভায় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসাইন, বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান আতাউর রহামান প্রধানসহ বিভিন্ন ব্যাংকের এমডিরা।

বৈঠক শেষে ডলারের বাড়তি মুনাফার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এখন ডলারের টানাপড়েন চলছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আজকে বাফেদা ও বাংলাদেশ ব্যাংক বৈঠক করেছে। ডলারের মার্কেট যাতে খুব কম সময়ের মধ্যে স্থিতিশীল করা যায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

ব্যাংকগুলো আমদানির রেটের চেয়ে রপ্তানিতে ডলারের মূল্য অনেক কম দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, আমরা নিয়মিত বাজার পরিদর্শন করছি। এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো যে রেটে রপ্তানির ডলার কেনে, পরবর্তীতে আমদানি এলসির করার সময় সেই রেটের ব্যবধান যেন বেশি না হয়। এজন্য একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে মুনাফা করতে বলা হয়েছে। 

ডলার কেনা ও বিক্রির মধ্যে ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ মুনাফা করবে এমন কোনো বিষয় নির্ধরণ করে দেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, বাফেদার কাছ থেকে এমন প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। তারা প্রস্তাব দিলে তা পর্যালোচনা করে আমরা নির্ধারণ করে দেব। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এসআই/জেডএস