কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা ‘অমান্য’, আন্দোলনে নামছেন ব্যাংকাররা
করোনার সময় খরচ কমানোর নামে কর্মী ছাঁটাই করেছে অনেক ব্যাংক। আবার অভিনব কায়দায় অমানবিকভাবে অনেককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ছাঁটাই বন্ধ ও কোভিডকালীন চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য হওয়া কর্মীদের চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দেয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
কিন্তু নির্দেশনা দেওয়ার নয় মাস পার হলেও চাকরি ফিরে পাননি বেশির ভাগ ভুক্তভোগী। বিষয়টি একাধিকবার বাংলাদেশ ব্যাংকে জানানো হলেও মেলেনি কোনো সমাধান। এমনকি পুনর্বহালের আশ্বাসও পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে বিষয়টি। এমন অবস্থায় দ্রুত চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে এবার আন্দোলনে নামছেন ছাঁটাই ও পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যাংকাররা।
বিজ্ঞাপন
আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামীকাল বুধবার (১৫ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে মানববন্ধনের ডাক দিয়েছেন ছাঁটাই ও পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যাংকাররা।
মানববন্ধন প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকারদের সমন্বয়কারী জানান, করোনাকালে কর্মী ছাঁটাই না করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক তাদের অনেক কর্মীকে চাকরি থেকে অন্যায়ভাবে পদত্যাগে বাধ্য, আবার কাউকে ছাঁটাই করেছে।
ছাঁটাই ও পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যাংকাররা জানান, গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাকরিতে পুনর্বহালে নির্দেশনা দিয়েছে। নয় মাস হয়ে গেছে কিন্তু পুনর্বহালে নির্দেশনা পরিপালনে গড়িমসি করছে ব্যাংকগুলো। এমনকি চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা
তিনি জানান, বেআইনিভাবে পদত্যাগে বাধ্য ও ছাঁটাই করা কর্মকর্তাদের বহালের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্তপূর্বক প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সার্কুলার (বিআরপিডি সার্কুলার নং- ২১ তারিখ ১৬-০৯-২০২১) জারি করেছে। নির্দেশনা অনুযায়ী আবেদন করার পরও অনেক ব্যাংক তাদের কর্মীদের বহাল করছে না। অন্যায় চাকরিচ্যুতিতে ব্যাংকগুলোর উন্নয়নে অবদান রাখা কয়েক হাজার অভিজ্ঞ ব্যাংক কর্মকর্তা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক তাগাদা দেওয়ার পরও বেশির ভাগ ব্যাংকের শীর্ষনির্বাহীরা সার্কুলার অনুযায়ী কর্মীদের বহালে বিভিন্নভাবে কালক্ষেপণ করছেন। এর প্রতিবাদে এবং অনতিবিলম্বে আবেদনকারী কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে।
করোনাকালে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য হন বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের এমন এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) জানান, অফিস চলাকালে হঠাৎ মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগ (এইচআরডি) থেকে আমাকে বলা হয়, আপনাকে রিজাইন করতে হবে। কী কারণে, জানতে চাইলে কিছুই না বলে শুধু বলা হয়, ম্যানেজমেন্টের নির্দেশ। রিজাইন না দেওয়ায় কয়েক দিন পর ফের আমাকে ডেকে নিয়ে বলা হয়, রিজাইন কেন করছি না। কারণ জানতে চাইলে রুমের দরজা বন্ধ করে আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হয়। ওই সময় কারও সঙ্গে যেন যোগাযোগ করতে না পারি সেজন্য মোবাইল ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়। পরে জোরপূর্বক রিজাইন পেপারে সই করানো হয়। এভাবে শত শত ব্যাংকারকে কোনো কারণ ছাড়াই পদত্যাগ করতে হয়েছে মহামারির সময়।
ছাঁটাই ও পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যাংকাররা জানান, গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাকরিতে পুনর্বহালে নির্দেশনা দিয়েছে। নয় মাস হয়ে গেছে কিন্তু পুনর্বহালে নির্দেশনা পরিপালনে গড়িমসি করছে ব্যাংকগুলো। এমনকি চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে না।
ছাঁটাই ও পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যাংকারদের দাবি, কয়েকটি ব্যাংক অল্পসংখ্যক লোক পুনর্বহাল করেছে। সংখ্যা বিবেচনায় খুবই কম। চাকরি গেছে তিন হাজারের বেশি, এর মধ্যে ১০ শতাংশও চাকরি ফিরে পাননি। বিষয়টি জানিয়ে গত মাসে গভর্নরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি
চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশনা মানা হচ্ছে না, এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো তাদের কর্মীদের পুনর্বহাল করছে। আমাদের ব্যাংকও প্রায় ৮০ জনকে পুনর্বহাল করেছে। এখন ঢালাওভাবে বলবেন, ‘করছে না’; এমন অভিযোগ ঠিক নয়। ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে দুই-তিনটা ব্যাংক হয়তো কম করছে। এটা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিষয়। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে পুনর্বহাল হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য আছে বলে তিনি দাবি করেন।
তবে ছাঁটাই ও পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যাংকারদের দাবি, কয়েকটি ব্যাংক অল্প সংখ্যক লোক পুনর্বহাল করেছে। সংখ্যা বিবেচনায় তা খুবই কম। চাকরি গেছে তিন হাজারের বেশি, এর মধ্যে ১০ শতাংশও চাকরি ফিরে পাননি। বিষয়টি জানিয়ে গত মাসে গভর্নরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
সর্বশেষ বিষয়টি জানিয়ে গত ২৫ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। সেই চিঠিতে বলা হয়, ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূরীকরণে আপনার (প্রধানমন্ত্রী) প্রচেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধ কর্মী ছাঁটাইয়ে জড়িত ব্যাংকগুলো বেশ কয়েক হাজার ব্যাংককর্মীকে একই প্রক্রিয়ায় চাকরিচ্যুত করেছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই পদত্যাগপত্র স্বাক্ষরের আগে/পরে স্ব স্ব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও টপ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগে বাধ্য না করা এবং পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করা বা বিলম্বিত করে সময় দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাতে চাইলে করোনাকে ব্যবহার করে সেই সুযোগও আমাদের দেওয়া হয়নি। বেশ কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে করোনায় আক্রান্ত অবস্থায়, হার্ট অপারেশন পরবর্তী হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় এবং অন্যান্য অসুস্থতায় চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়ও উপর্যুপরি ফোন দিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে পদত্যাগপত্র পাঠাতে বাধ্য করা হয়েছে।
চিঠিতে তারা দাবি করেন, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই পদত্যাগের চাপ প্রয়োগের কোনো ডকুমেন্টস যাতে না থাকে সেজন্য পরিকল্পিতভাবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বা মানবসম্পদ বিভাগ লিখিত নির্দেশ না দিয়ে মৌখিকভাবে বা ফোনে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে আমাদের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র আদায় করে নিয়েছে।
অফিস চলাকালে হঠাৎ মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগ থেকে আমাকে বলা হয়, আপনাকে রিজাইন করতে হবে। কী কারণে, জানতে চাইলে কিছুই না বলে শুধু বলে ম্যানেজমেন্টের নির্দেশ। এরপর আমি রিজাইন না দেওয়ায় কয়েক দিন পর ডেকে নিয়ে বলা হয়, রিজাইন কেন করছি না। আমি কারণ জানতে চাইলে রুমের দরজা বন্ধ করে আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়— নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা
চিঠিতে আরও বলা হয়, চাকরিতে পুনর্বহালের সার্কুলার বাস্তবায়নের মাধ্যমে চাকরি ফেরত পেলে আমাদের মতো অসহায় ব্যাংককর্মীরা আমৃত্যু আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। এছাড়া এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ব্যাংকারদের চাকরির নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে মেধাবীরা ব্যাংকিং পেশায় আকৃষ্ট হবে, কর্মরত ব্যাংকারদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে হতাশা দূর হবে; হতাশা থেকে উদ্ভূত অনিয়মের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। সর্বোপরি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার কার্যকর করার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ়করণ ও ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাবে, অনিয়ম হ্রাস পাবে।
অন্যথায় সার্কুলার বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ভরতা হ্রাস পাবে, ব্যাংকাররা চাকরির নিরাপত্তাহীনতায় সব অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হবেন। যা ব্যাংক খাতে বিশেষত বেসরকারি ব্যাংক খাতে মেধাবীদের প্রবেশ নিরুৎসাহিত করবে।
ব্যাংকারদের অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর বেসরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকে কর্মী ছাঁটাই বিষয়ে বিশেষ পরিদর্শনে নামে। পরিদর্শনে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই ব্যাংকগুলোর মোট তিন হাজার ৩১৩ জন কর্মকর্তা 'স্বেচ্ছায়' চাকরি ছেড়েছেন। এর মধ্যে বয়স থাকার পরও স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখানো হয়েছে তিন হাজার ৭০ জনকে। এছাড়া ২০১ জনকে অপসারণ, ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও ১২ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখানো বেশির ভাগই জানিয়েছেন, পদত্যাগের জন্য মৌখিকভাবে তাদের একটি সময় দেওয়া হয়েছিল। ওই তারিখের মধ্যে পদত্যাগ না করলে কোনো সুবিধা দেওয়া হবে না— এ ভয় দেখানো হয়। এমন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাধ্য হয়ে তারা পদত্যাগ করেন।
এরপরই ব্যাংক কর্মীদের ছাঁটাই বন্ধে গত ১৬ সেপ্টেম্বর নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, এখন থেকে সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত অভিযোগ ছাড়া কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। পাশাপাশি মহামারি কোভিডকালীন চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যাংককর্মীদের চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এসআই/জেডএস