খোলা বাজারে এখনো চড়া ডলারের দাম
দেশের বাজারে মার্কিন ডলারের দামে অস্থিরতা কাটাতে এক রেট বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে করে আন্তব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম কমলেও কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে এখনো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ডলার।
সোমবার (৩০ মে) বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক, এক্সচেঞ্জ হাউজ ও ডলার কেনাবেচার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
সোমবার বিকেলে কথা হয়, রাজধানীর গুলশানের আইডিয়াল মানি এক্সচেঞ্জ স্বত্বাধিকারী রাসেলের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, আজ ডলার বিক্রি করছি ৯৭ টাকা ১০ পয়সা। আর কেউ আমাদের কাছে বিক্রি করতে এলে দাম ৯৬ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছি। দাম তেমন কমেনি। এখনো বাজার চড়া। ১০ দিন আগে খোলা বাজারে এ ডলার ১০০ টাকার উপরে বিক্রি হয়েছিল।
ডলারের একই রেটের তথ্য জানায় সুগন্ধা এক্সচেঞ্জ হাউজ। প্রতিষ্ঠানটির ডলার কেনাবেচার সঙ্গে দায়িত্বরত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোস্তফা জানান, আজকে ৯৭ টাকা বিক্রি করছি, আর কিনছি ৯৬ টাকায়। দাম কমবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক দর বেঁধে দিলেও খোলা বাজারে দাম কমেনি। আর বেশি কমবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ করোনার পর সব দেশ তাদের বর্ডার খুলে দিয়েছে। এখন বিদেশ ভ্রমণ বেড়েছে। অনেকে শিক্ষা চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন, সামনে হজে যাবেন। এখন প্রচুর নগদ ডলারের প্রয়োজন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। তই দাম কমার খুব একটা সম্ভাবনা নেই বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশ (এবিবি) এর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রোববার (২৯ মে) বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার ৮৯ টাকা বেঁধে দেয়। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির জন্য বিসি সেলিং রেট নির্ধারণ করা হয় ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা। তবে ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৯ টাকা ৮০ পয়সার প্রস্তাব করেছিল।
সোমবার বিভিন্ন ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা মুদ্রার বিনিময় হারের তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া ৮৯ টাকা দরে নিজেদের মধ্যে ডলার কেনাবেচা করেছে। আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির রেট ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করে দিয়ে রেখেছে। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে নগদ ডলার ৯৬ থেকে ৯৭ টাকায় বিক্রি করছে।
সোমবার পূবালী ব্যাংক খুচরা প্রতি ডলার বিক্রি করছে ৯৫ টাকা ৫০ পয়সা, আর কিনছে ৯৪ টাকা ৫০ পয়সা।
দি সিটি ব্যাংক নগদ খুচরায় প্রতি ডলার বিক্রি করছে ৯৬ টাকা, আর কিনছে ৯৪ টাকায়। সিটি ব্যাংক বিসি সেলিং বা আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া রেট ৮৯ টাকা ১৫ পয়সায়।
আইএফআইসি ব্যাংকও আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া রেটে। তবে খুচরায় প্রতি ডলার বিক্রি করছে ৯৭ টাকা, আর তারা কিনছে ৯৫ টাকা ৫০ পয়সায়।
ইউসিবি ব্যাংক খুচরায় প্রতি ডলার বিক্রি করছে ৯৭ টাকা, আর তারা কিনছে ৯৪ টাকায়। তাদের বিসি সেলিং রেট ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা।
এবিবির এক নেতা ঢাকা পোস্টকে জানান, আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে রেট দিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা পর্যালোচনা করে রেট নির্ধারণ করে দিয়েছে। আজকে সেই রেটেই আমদানির দায় পরিশোধ করছি। তবে খুচরা ডলারের দাম বেশি এটা ঠিক। কারণ বিদেশ যেতে অনেকে ডলার নিয়ে যাচ্ছে। হজ করতেও নগদ ডলার সঙ্গে নিয়ে যাবে। এসব কারণে চাহিদা বেশি হওয়ায় দামও বেশি। তবে এটাও কমে যাবে।
রপ্তানি কম ও আমদানি বেশি হওয়ার দোহাই দিয়ে ডলারের দাম বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। বৈদেশিক এই মুদ্রা হাতে রেখেই কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রপ্তানিকারকদের। তারা বলছেন, অল্প দামে ডলার কিনে ধরে রেখেছেন। এখন সেই ডলার বিক্রি করে অধিক মুনাফা নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে ব্যাপক হারে আমদানির চাপ বেড়েছে। ফলে আমদানির দায় পরিশোধে বাড়তি ডলার লাগছে। কিন্তু সেই তুলনায় রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়েনি। ফলে ব্যাংক-ব্যবস্থা ও খোলা বাজারে মার্কিন ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে কারণে টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু তারপরও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না ডলার।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এরপর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
২০২১ সালের আগস্টের শুরুতেও আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের মূল্য একই ছিল। ৩ আগস্ট থেকে দু'এক পয়সা করে বাড়তে বাড়তে গত বছরের ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতাে ৮৫ টাকা ছাড়ায়। এ বছরের ৯ জানুয়ারিতে এটি বেড়ে ৮৬ টাকায় পৌঁছে। এরপর ২২ মার্চ পর্যন্ত এ দরেই স্থির ছিল। পরে গত ২৩ মার্চ আন্তঃব্যাংকে আরও ২০ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়ায়। ২৭ এপ্রিল আরও ২৫ পয়সা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। ১০ মে বাড়ে আরও ২৫ পয়সা। ১৬ মে বাড়ে ৮০ পয়সা। ২৩ মে বাড়ে ৪০ পয়সা।
বাজার স্থিতিশীল রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৬ মে পর্যন্ত ৫৭০ কোটি (৫.৭০ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তারপরও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না ডলার। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক নির্বাহীদের সঙ্গে আলোচনা করে ডলারের একক রেট বেঁধে দেওয়া হয়। রোববার (২৯ মে) আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারে ৮৯ টাকা এবং বিসি সেলিং রেট ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
যদিও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল, রপ্তানি বিল নগদায়নে ডলারের রেট হবে ৮৮ টাকা ৯৫ পয়সা, প্রবাসী আয় আনা হবে ৮৯ টাকা ৮০ পয়সা, আন্তব্যাংকে ডলার কেনাবেচার জন্য ৮৯ টাকা ৮৫ পয়সা ও আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি হবে (বিসি সেলিং রেট) ৮৯ টাকা ৯৫ পয়সা।
এসআই/জেডএস