উল্টো পথে ব্যাংক
মহামারি করোনার ধাক্কা কাটিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার প্রত্যাশায় শুরু হয় ২০২১ সাল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে। বছরের একটা অংশ পার হয় কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে। এ সময় বেসরকারি খাতের ঋণ ছিল গতিহীন। ব্যাংকে জমে টাকার পাহাড়। নিত্যপণ্যে কাঁদেন সাধারণ ভোক্তা। নিম্নমুখী সুদহারে বেকায়দায় পড়েন ব্যাংকের আমানতকারীরা। সুদ বেঁধে দিলেও সুরক্ষা পাননি গ্রাহক। নানা ছাড়েও লাগাম টানা যায়নি খেলাপিঋণের। আমদানির চাপে অস্থির ছিল ডলার।
এছাড়া নানা অজুহাতে কর্মীছাঁটাই, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতি, ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসসহ নানা চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয় বিদায় হতে যাওয়া ২০২১ সাল।
বিজ্ঞাপন
খেলাপিঋণ
মহামারি করোনায় সৃষ্ট অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় ২০২০ সালজুড়ে ঋণের কিস্তির এক টাকা শোধ না করলেও গ্রাহককে খেলাপি করতে পারেনি ব্যাংক।। ফলে কাগজে-কলমে কমে যায় খেলাপিঋণ। খাতার হিসাবে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি ৬ লাখ টাকার খেলাপিঋণ নিয়ে শুরু হয় ২০২১ সাল। এ বছর আগের মতো সুযোগ দেওয়া না হলেও অনেক ক্ষেত্রে ঢালাও সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন শিথিলতার আওতায় চলতি বছর একজন গ্রাহকের যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধের কথা, ডিসেম্বরের মধ্যে তার ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলেও তাকে আর খেলাপি করা যাবে না। এরপরও বাড়ছে খেলাপিঋণ।
প্রথম ছয় মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকায়। এখন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে এটি। সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয় এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা।
প্রথম ছয় মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকায়। এখন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে এটি। সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয় এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা।
প্রণোদনা ঋণ নিয়ে ‘নয়-ছয়’
করোনাকালে সংকট উত্তরণে সরকার বিভিন্ন খাতে মোটা অঙ্কের প্রণোদনা ঋণ দেয়। এখন পর্যন্ত ২৩টি প্যাকেজের আওতায় দুই দফায় আড়াই লাখ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ঋণনির্ভর প্রণোদনা প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। মহামারিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের এ প্যাকেজ নিয়েও অনিয়ম, ঋণজালিয়াতি ও বেআইনিভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের অভিযোগ ওঠে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর জরিপে উঠে এসেছে, দুর্নীতিবাজদের ঘুষের পাতা ফাঁদ সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতার অভাব, জবাবদিহির পাট চুকে যাওয়া ও দুর্নীতিবাজদের কারণে দেশের ৭৯ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই ঘোষিত ওই প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ পায়নি! শুধু তা-ই নয়, বরাদ্দ দেওয়া অর্থছাড়ের জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অনেকেরই উৎকোচ দাবির নগ্নচিত্রও উঠে এসেছে।
সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক দুই লাখ ১৯ হাজার ২৯২ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। যার ২০ শতাংশ অর্থাৎ ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা খেলাপিঋণ। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ সাত হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। বিডিবিএল’র ৫৬০ কোটি, বেসিক ব্যাংকের সাত হাজার ৬১৯ কোটি, জনতা ব্যাংকের ১৩ হাজার ৮৭৩ কোটি, রূপালী ব্যাংকের তিন হাজার ৮৩৪ কোটি এবং সোনালী ব্যাংকের খেলাপিঋণ ছিল ১০ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা।
সংকটে ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক
লাগামহীন খেলাপি, নানা সংকট ও মূলধন ঘাটতিতে বছর পার করছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক দুই লাখ ১৯ হাজার ২৯২ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। যার ২০ শতাংশ অর্থাৎ ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা খেলাপিঋণ। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ সাত হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। বিডিবিএল’র ৫৬০ কোটি, বেসিক ব্যাংকের সাত হাজার ৬১৯ কোটি, জনতা ব্যাংকের ১৩ হাজার ৮৭৩ কোটি, রূপালী ব্যাংকের তিন হাজার ৮৩৪ কোটি এবং সোনালী ব্যাংকের খেলাপিঋণ ছিল ১০ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা।
এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এ উচ্চ খেলাপির জন্য নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।
আমদানির পালে হওয়া
গত অক্টোবরে দেশে ৭১১ কোটি (৭.১১ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) যা ৬১ হাজার কোটি টাকার ওপরে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য আমদানিতে এত বেশি অর্থব্যয় হয়নি।
গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং লকডাউনে কারখানার উৎপাদন বন্ধ বা সীমিত থাকায় নতুন করে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। ফলে শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানি কম ছিল। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই অবস্থা পাল্টে আমদানিতে রেকর্ডের পর রেকর্ড হয়।
গত অক্টোবরে দেশে ৭১১ কোটি (৭.১১ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) যা ৬১ হাজার কোটি টাকার ওপরে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য আমদানিতে এত বেশি অর্থব্যয় হয়নি।
এদিকে, আমদানির পালে হওয়া লাগায় বাড়ছে ডলারের চাহিদা। ফলে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে পড়েছে টান।
অস্থির ডলারের বাজার
বছরজুড়েই অস্থির ছিল ডলারের বাজার। বাড়তি চাহিদার কারণে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে মার্কিন ডলারের দাম। মান হারায় দেশীয় মুদ্রা ‘টাকা’। ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এরপর থেকে বড় ধরনের আমদানি-ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলারের সংকট শুরু হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ ডিসেম্বর ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে লেনদেনের জন্য প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়। তবে খোলাবাজার ও নগদ মূল্যে তা আরও বেশি দাঁড়ায়। যারা ভ্রমণ করতে বিদেশে যাচ্ছেন তাদের ৯০ থেকে ৯২ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে ডলার।
এমন পরিস্থিতিতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ২০৩ কোটি ২০ লাখ অর্থাৎ ২০৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে জানান, ডলারের মূল্য প্রায় দুই বছর স্থিতিশীল ছিল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় দেশে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও পণ্য আমদানি বেড়েছে। এসব পণ্যের দায় ও আগের বকেয়া পরিশোধ করতে বাড়তি ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে। তাই দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা মজুত রয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে।
রেমিট্যান্সে ধস
দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে ভালো সূচক হলো প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ, রেমিট্যান্স। চলতি বছরের প্রথম কয়েক মাস এটি ভালো অবস্থায় থাকলেও পরে ভাটা পড়ে। মহামারি করোনার মধ্যেও উল্লম্ফনে থাকা প্রবাসী-আয় টানা ছয় মাস ধারাবাহিকভাবে কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, গত নভেম্বর মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ (১.৫৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে পাঠিয়েছেন। প্রবাসী আয়ের এ অঙ্ক গত ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এসবিএসি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের কাণ্ড
ব্যাংকপাড়ায় বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেনের নাম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, নামে-বেনামে তিনি ব্যাংকের অর্থ সরিয়েছেন। ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে তুলে নিয়েছেন টাকা। পাশাপাশি কর্মচারীদের নামে ঋণ নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর প্রতিবেদন বলছে, খুলনা বিল্ডার্স নামের একটি নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমানতকারীদের ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন আমজাদ হোসেন। এমন অভিযোগে মামলাও হয়েছে দুদকে। শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।
অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতায় বছরের শুরু থেকেই আলোচনায় ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। দীর্ঘদিন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন সিকদার গ্রুপের জয়নুল হক সিকদার। গত ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। ২৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। এরপর বেশ কিছুদিন কোনো পর্ষদসভা না হলেও প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। যার সুবিধাভোগী নিয়ে বড় প্রশ্ন ওঠে এবং বেশকিছু অনিয়মের ইঙ্গিতও পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে নামে-বেনামে ঋণ বিতরণ ঠেকাতে নতুন করে ন্যাশনাল ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতায় বছরের শুরু থেকেই আলোচনায় ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। দীর্ঘদিন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন সিকদার গ্রুপের জয়নুল হক সিকদার। গত ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। ২৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। এরপর বেশ কিছুদিন কোনো পর্ষদসভা না হলেও প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। যার সুবিধাভোগী নিয়ে বড় প্রশ্ন ওঠে এবং বেশকিছু অনিয়মের ইঙ্গিতও পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে নামে-বেনামে ঋণ বিতরণ ঠেকাতে নতুন করে ন্যাশনাল ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এছাড়া নানা অভিযোগে চলতি বছর ব্যাংকটির দুই ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রথমে অনিয়মের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক এমডি বুলবুলকে নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিচালকদের ক্রেডিট কার্ডের তথ্য গোপনসহ অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির শিকার হয়ে সবশেষ শাহ সৈয়দ আবদুল বারীও নভেম্বরে পদত্যাগ করেন। এখন নতুন এমডি হয়েছেন মেহমুদ হোসেন।
আলোচনায় ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান
বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। বছরের শুরুতে বেসরকারি খাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড’র বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির তথ্য বেরিয়ে আসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা ঋণ বের করে নেন। যার নথিপত্রও গায়েব করে ফেলা হয়।
সারা বছর আদালতের দিকে তাকিয়ে ছিল অবসায়ন প্রক্রিয়ায় থাকা ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড’র আমানতকারীরা। এখন পর্যন্ত জমানো টাকা ফেরতে কোনো নিশ্চয়তা পাননি তারা। চলতি বছরের ২১ জুন প্রতিষ্ঠানটির পুনর্গঠন বা পুনরুজ্জীবিতের নির্দেশনা চেয়ে ২০১ আমানতকারী হাইকোর্টে আবেদন জানান। ওই আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ২৮ জুন পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড-কে পুনর্গঠন বা পুনরুজ্জীবিত করে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য একটি বোর্ড গঠন করে দেন হাইকোর্ট।
এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও খুঁড়িয়ে চলছে।
দুই ডেপুটি গভর্নরসহ তিন ইডিকে জিজ্ঞাসাবাদ
অনিয়মে সহায়তা করার অভিযোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক দুই ডেপুটি গভর্নর ও বেশ কয়েকজন নির্বাহী পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ ছিল শেষ হতে যাওয়া বছরের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার আগে কখনও হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থের বিনিময়ে অনিয়ম গোপন ও নানা কেলেঙ্কারিতে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের বিরুদ্ধে। এছাড়াও বিভিন্ন অপকর্মে সহযোগিতা করেছেন সাবেক ও বর্তমান আরও বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের কারণ উদঘাটনে গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (কারণ উদ্ঘাটন) কমিটি।
যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তারা হলেন- সাবেক ডিজি এস কে সুর, এস এম মনিরুজ্জামান, সাবেক নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান, শেখ আব্দুল্লাহ এবং বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম।
ব্যাংক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস
গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন পাঁচটি সরকারি ব্যাংকের এক হাজার ৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ’ পদের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে এক ঘণ্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর একাধিক প্রার্থী অভিযোগ করেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০০টি প্রশ্নের প্রিন্ট করা উত্তরপত্র ফেসবুকে পাওয়া গেছে। এমন অভিযোগ ওঠার পর পরীক্ষা বাতিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটি।
সরকারি ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ফাঁস— চলতি বছরের শেষ সময়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন পাঁচটি সরকারি ব্যাংকের এক হাজার ৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ’ পদের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে এক ঘণ্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর একাধিক প্রার্থী অভিযোগ করেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০০টি প্রশ্নের প্রিন্ট করা উত্তরপত্র ফেসবুকে পাওয়া গেছে। এমন অভিযোগ ওঠার পর পরীক্ষা বাতিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটি। ওই ঘটনায় দায়িত্বে থাকা আহছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আমানতের সুদে হ-য-ব-র-ল
বছরজুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দুর্বিষহ ছিল জনজীবন। কিন্তু উল্টো চিত্র দেখা যায় ব্যাংকের আমানতের সুদহারে। এর ওপর নির্ভরশীল স্বল্প ও মধ্য আয়ের সাধারণ পেশার মানুষ মহামারির ধকল সামলে ওঠার আগেই নতুন করে বিপাকে পড়েন। বছরের মাঝামাঝিতে আমানতের সুদহার ২ থেকে তিন শতাংশে নেমে যায়। পরে বাধ্য হয়ে ঋণের পর আমানতের সুদহারও বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত বছরের এপ্রিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেয়। চলতি বছরের আগস্টে বেঁধে দেওয়া হয় আমানতের সুদহার। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এখন থেকে তিন মাস ও এর বেশি মেয়াদি আমানতের সুদ কোনোভাবেই তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির কম হতে পারবে না।
সঞ্চয়পত্র
বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে সুদহার কমানো হয়েছে। আবার ঘোষণার বাইরে সঞ্চয়পত্র থাকলে জেল-জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে। এ কারণে অনেকে সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ কমিয়েছে। এর প্রভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে পড়েছে ভাটা।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৩৫ হাজার ৩২৮ কোটি টাকার জাতীয় সঞ্চয় স্কিম বিক্রি হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ছয় হাজার ৩১৭ কোটি টাকা অর্থাৎ ৪০ শতাংশ কম। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে নিট ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকারের। প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার ২৯ শতাংশ ঋণ নেয় সরকার।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৩৫ হাজার ৩২৮ কোটি টাকার জাতীয় সঞ্চয় স্কিম বিক্রি হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ছয় হাজার ৩১৭ কোটি টাকা অর্থাৎ ৪০ শতাংশ কম। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে নিট ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকারের। প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার ২৯ শতাংশ ঋণ নেয় সরকার।
সরকারের ব্যাংকঋণ
ঘাটতি মেটাতে সরকার এখন ব্যাংকঋণে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকারের কোনো ব্যাংকঋণ ছিল না। ওই সময়ে ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বেশি ছিল।
বেসরকারি খাতের ঋণ
গত বছর করোনার ধাক্কায় তলানিতে নামার পর বর্তমানে গতি ফিরছে বিনিয়োগ খাতে। বছরের প্রথমার্ধে কিছুটা গতিহীন থাকলেও পরে আমদানি-রফতানি বাড়তে থাকে। সঙ্গে সমান তালে বাড়তে থাকে উন্নয়নের অন্যতম সূচক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ১৯ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ১৪ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। এ হিসাবে অক্টোবর মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
রিজার্ভ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ৩ মে দেশের রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ওইদিন রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ ৪৪.০২ বিলিয়ন অর্থাৎ চার হাজার ৪০২ কোটি ডলার ছাড়ায়। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
করোনা মহামারির মধ্যেও রিজার্ভের পরিমাণ একের পর এক রেকর্ড গড়ে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে রিজার্ভ গত ২৪ আগস্ট ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। ওইদিন রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ চার হাজার ৮০৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলারের আমদানি-ব্যয় হিসাবে মজুত এ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে ১২ মাসের আমদানি-ব্যয় মেটানো সম্ভব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ৩ মে দেশের রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ওইদিন রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ ৪৪.০২ বিলিয়ন অর্থাৎ চার হাজার ৪০২ কোটি ডলার ছাড়ায়। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
ঋণ দিয়ে শ্রীলঙ্কার পাশে বাংলাদেশ
এক সময় ঋণ পেতে মরিয়া ছিল বাংলাদেশ। দিন বদলে গেছে। এখন অন্য দেশকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। সরকার বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কাকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এর মধ্যে আগস্টে পাঁচ কোটি ডলার ছাড় করে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪২৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাধীনে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এ অর্থ দেওয়া হয়। এ ঋণছাড়ের মাধ্যমে প্রথম কোনো দেশকে ঋণ দিল বাংলাদেশ।
এসআই/এমএআর/