অনিয়মিত করদাতা যখন ভয়ংকর বিপদে!
করদাতা আহসান আলী। কাগজে-কলমে তার স্থায়ী ঠিকানা খিলগাঁও। কর অঞ্চল-৫ এর আওতায় ১৯৮৮ সালে কর শনাক্তকরণ নম্বরের (টিআইএন) নিবন্ধন নেন। ওই টিআইএনের বিপরীতে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন তিনি।
এরপর বাড়ি বিক্রি করে খিলগাঁও ছেড়ে চলে যান। অজানা কারণে ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করেননি। ওই সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে আয়কর কিংবা রিটার্নের হিসাব রাখত।
বিজ্ঞাপন
অনেক খোঁজাখুঁজির পর আহসান আলীকে পাওয়া গেল মোহাম্মদপুরে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর গত নয় মাস ধরে তিনি জেলে।
২০০০ সালের আগের আয়করের সব তথ্য গোপন করে কর অঞ্চল-২ এর আওতায় নতুন টিআইএন নিবন্ধন নেন আহসান আলী। এর বিপরীতে আয়কর রিটার্ন দাখিল শুরু করেন। ২০১৩ সালে ইলেকট্রনিক ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর (ই-টিআইএন) নেন এবং নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করেন।
হঠাৎ করদাতা আহসান আলীর জীবনে নেমে আসে ভয়ংকর বিপদ। আগের টিআইএনের বিপরীতে বছরের পর বছর ধরে তার কর ও জরিমানা হচ্ছে, তা হয়তো বুঝতে পারেননি তিনি। বিগত পাঁচ বছরে সাত লাখ ৬২ হাজার টাকার কর দাবি করে আহসান আলীকে কয়েক দফা নোটিশ দেয় কর অফিস। কোনো সাড়া না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করে কর বিভাগ। একই সঙ্গে খিলগাঁও থানার মাধ্যমে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করা হয়।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর আহসান আলীকে পাওয়া গেল মোহাম্মদপুরে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর গত নয় মাস ধরে তিনি জেলে।
এমন বিপদে যারা পড়তে চান না তাদের অবশ্যই এনবিআরের নির্ধারিত ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার আহ্বান জানিয়েছে কর বিভাগ। বিশেষ করে অনিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক সদস্য (আয়কর) কালিপদ হালদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আয়কর আইনে ই-টিআইএন থাকলে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। আমার আহ্বান থাকবে, জরিমানা ও জটিলতা এড়াতে সবারই নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করা।
তিনি আরও বলেন, কর দেওয়া ও রিটার্ন দাখিল করা নাগরিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই বিড়ম্বনা এড়াতে করদাতাদের অবশ্যই সর্তক থাকা জরুরি। নিয়মিত রিটার্ন না দেওয়ার কারণে করদাতাকে অহেতুক নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। আমি দায়িত্বে থাকাকালীন এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেখেছি। অনেক ক্ষেত্রে মানবিক কারণে ছাড় দিয়েছি। তবে করদাতার উচিত অহেতুক ঝামেলা এড়াতে নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করা।
দীর্ঘদিন আয়কর আইনজীবী হিসেবে কর্মরত ইমরান গাজী। আয়কর রিটার্ন দাখিল না করার বিড়ম্বনা কিংবা অনিয়মিত রিটার্ন দাখিলের বিষয়ে জানতে চাই তিনিও করদাতাদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আয়কর নিয়ে করদাতাদের মধ্যে এক ধরনের অবহেলা রয়েছে। পরবর্তীতে তারা নানা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েন। আমাদের কাছে মানুষ সাধারণত বিপদে পড়লেই আসেন। কিন্তু এমন সময় আসেন যখন তার অনেকটা ক্ষতি হয়ে যায়।
কোনো ব্যক্তি-করদাতার আয় যদি বছরে তিন লাখ টাকার বেশি হয়; তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, নারী ও ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সের করদাতার আয় যদি বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি হয়, গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার আয় যদি বছরে চার লাখ ৭৫ হাজার টাকার বেশি হয় এবং প্রতিবন্ধী করদাতার আয় সাড়ে চার লাখ টাকার বেশি হয়, তাহলে তার রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক।
‘আইন অনুযায়ী, অনিয়মিত রিটার্ন দাখিলের কোনো সুযোগ নেই। অনেকেরই ধারণা চাইলেই কর অফিস ম্যানেজ করা সম্ভব। কর জটিলতায় যে জেল ও জরিমানা হতে পারে, এ কথা করদাতারা বুঝতে চান না। তাদের উদ্দেশ্যে বলব, সবসময় টাকা থাকলেই সমস্যার সমাধান করা যায় না। বিপদমুক্ত থাকতে নিয়মিত আয়কর প্রদান ও রিটার্ন দাখিলের জন্য করদাতাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে।’
একজন করদাতার বার্ষিক আয়, ব্যয় ও সম্পদের তথ্য নির্ধারিত ফরমে উপস্থাপনের মাধ্যমই হচ্ছে আয়কর রিটার্ন। আয়কর আইন অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত ফরমে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়।
কোনো ব্যক্তি-করদাতার আয় যদি বছরে তিন লাখ টাকার বেশি হয়; তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, নারী ও ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সের করদাতার আয় যদি বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি হয়, গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার আয় যদি বছরে চার লাখ ৭৫ হাজার টাকার বেশি হয় এবং প্রতিবন্ধী করদাতার আয় সাড়ে চার লাখ টাকার বেশি হয়, তাহলে তার রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক।
এনবিআরের ২০২১-২২ অর্থবছরের আয়কর নির্দেশিকা অনুসারে মোট ২২ কারণে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক। করদাতা যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হন তাহলে আয়কর অধ্যাদেশের ১২৪, ৭৩ ও ৭৩-এ ধারা অনুযায়ী জরিমানা, ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত সুদ ও বিলম্ব সুদ আরোপযোগ্য হবে।
আরএম/এমএআর/ওএফ