করোনায় ‘ঝরে পড়া’ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে
করোনা মহামারিতে ২০২০ সালের মার্চ থেকে প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত সেপ্টেম্বর থেকে সীমিত আকারে খুলেছে স্কুলগুলো। কিন্তু স্কুল চালুর পর দেখা যাচ্ছে ‘ঝরে পড়া’ শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
ঝড়ে পড়ার মূলে রয়েছে বাল্য বিয়ে ও শিশুশ্রম। মহামারির সময় প্রায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ মেয়ে বাল্য বিয়ের শিকার। গত দুই বছরে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিকভাবে এই সংখ্যা ৮৬ মিলিয়নেও পৌঁছাতে পারে।
বিজ্ঞাপন
রোববার (২৫ অক্টোবর) এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) পক্ষ থেকে “অতিমারি-উত্তর শিশুদের স্কুলে ফেরা” শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংলাপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সংলাপে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের কোর গ্রুপ সদস্য শাহীন আনাম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির ফলে গত বছরের মার্চ মাস থেকে প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতি বিবেচনায় গত সেপ্টেম্বর থেকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সীমিত আকারে স্কুলগুলো খোলা হয়েছে। কিন্তু স্কুল খোলার পর দেখা যাচ্ছে ‘ঝরে পড়া’ শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।
সাম্প্রতিক গবেষণা ও জরিপ অনুযায়ী, এই সমস্যার মূল কারণ বাল্য বিয়ে ও শিশুশ্রম। করোনার সময় দেশের অধিকাংশ শিশু মূলত দারিদ্র্য এবং অন্যান্য সামাজিক কারণে বাল্য বিয়ে ও শিশুশ্রমের শিকার হয়েছে, যা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে অধিকতর তীব্র।
অনুষ্ঠানে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের আহ্বায়ক এবং সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রায় ১০-১২ শতাংশ মেয়ে শিশুরা বাল্য বিয়ের শিকার। এটি যতটা না অর্থনৈতিক, তার থেকেও অনেক বেশি সামাজিক সঙ্কট। অভিঘাতের ফলে শিশুদের পরিবারে বিভিন্ন ধরনের ব্যয়ের ক্ষেত্রে সঙ্কোচন হয়েছে। দেখা গেছে তারা কখনো আমিষের পরিমাণ কমিয়েছেন, কখনো খাবারের পদের পরিমাণ কমিয়েছেন, আবার কখনো একবেলা খাবারও কমিয়েছেন।
তবে আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তত ১৫-২০ শতাংশ পরিবারে শিশু খাদ্যের ক্ষেত্রেও ব্যয় সঙ্কোচন করতে হয়েছে, যা শিশুদের পুষ্টিহীনতা অনেকাংশে বাড়িয়েছে।
শাহীন আনাম প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বলেন, মহামারির কারণে শিশুশ্রম ও অল্পে বেতনে শিশুশ্রমিক নিয়োগ বেড়েছে। ৯ম ও ১০ম শ্রেণির মেয়েরা স্কুলে ফিরছে না, কারণ তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। মোট ২১টি জেলায় জরিপ চালানো হয়।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সের প্রায় ১৩ হাজার মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে যা আশঙ্কাজনক। যৌন নির্যাতন ও শারীরিক সহিংসতাও এর মধ্যে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে শাহীন আনাম, সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি ও সচেতনতা বাড়ানোর সুপারিশ করেন। পাশাপাশি সাহায্যের জন্য হেল্পলাইন নম্বর বাড়ানো এবং এই সঙ্কটকালীন সময়ে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ রোধে জাতীয় ক্যাম্পেইন এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মোট ১৫টি সামাজিক সেক্টর নির্ভর মন্ত্রণালয় আছে যাদের বাজেটের শতকরা ২০ ভাগ শিশুদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। এই বাজেট কীভাবে করা হচ্ছে এবং এর বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে কি-না তার সঠিক ফলোআপ করলে সমস্যা অনেকটা নিরসন করা সম্ভব।
সরকারের প্রস্তুতি ও পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার বাস্তবায়নে সমন্বয়ের ওপর জোর দিতে হবে উল্লেখ করে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিয়ে হয়ে যাওয়া শিশুরা উপবৃত্তি পাচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ে সামগ্রিকভাবে যাতে সব শিশু উপবৃত্তি পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) ন্যাশনাল প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর সৈয়দা মুনিরা সুলতানা সামাজিক আন্দোলনের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, গত দুই বছরে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৈশ্বিকভাবে এই সংখ্যা ৮৬ মিলিয়নেও পৌঁছাতে পারে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান এ সময় এসডিজিকে উদ্দেশ করে শিশুশ্রম নিরসনের জন্য একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির কথা জানান।
সংলাপে সম্মানিত আলোচক হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উপ-সচিব (বিদ্যালয়) নাজমা শেখ, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক মো. বেলাল হোসাইনসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সম্পৃক্ত সংস্থার প্রতিনিধি ও ব্যক্তিরা।
আরএম/ওএফ