অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় নাজুক দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও বছরের পর বছর আদায় হচ্ছে না ঋণ। দিন দিন বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এর মধ্যে অনেক মন্দ ঋণ আদায়-অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফলে খেলাপি ঋণের বোঝা কাগজে–কলমে কমাতে ঋণ অবলোপন বা ‘রাইট অফ’ পদ্ধতি বেছে নিয়েছে এনবিএফআই।

অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান এ পথ বেছে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে আভিভা ফাইন্যান্স লিমিটেড, লংকা বাংলা ও আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

২০০২ সালে চালু হয় ঋণ অবলোপন অর্থাৎ ‘রাইট অফ’ ব্যবস্থা। ২০১৯ সালের এপ্রিলে এসে এ ব্যবস্থার বেশকিছু নীতিমালা শিথিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন নিয়মে তিন বছরের মন্দ ও ক্ষতিমানে শ্রেণিকৃত ঋণ অবলোপনের সুযোগ দেওয়া হয়। আগে যা ছিল পাঁচ বছর। এছাড়া দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ মামলা অবলোপনের সুযোগ পায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

২২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এক হাজার ৮৬১ কোটি পাঁচ লাখ টাকার মন্দ ঋণ রাইট অফ করেছে। এর মধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠান রাইট অফ করেছে এক হাজার ৫০৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। যা মোট রাইট অফের ৮১ শতাংশ। এর মধ্যে নামিদামি প্রতিষ্ঠানই বেশি

আর্থিক খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করায় খেলাপিরা আরও বেশি উৎসাহিত হয়েছেন। এখন তাদের ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা আরও বেড়েছে। অন্যদিকে, ব্যালান্সশিট ভালো দেখাতে ব্যাংকগুলো এ সুবিধা নিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে আড়াল হচ্ছে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, নীতিমালা শিথিলের পর রাইট অফের প্রবণতা বেড়েছে। ২২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এক হাজার ৮৬১ কোটি পাঁচ লাখ টাকার মন্দ ঋণ রাইট অফ করেছে। এর মধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠান রাইট অফ করেছে এক হাজার ৫০৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। যা মোট রাইট অফের ৮১ শতাংশ। এর মধ্যে নামিদামি প্রতিষ্ঠানই বেশি।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঋণ অবলোপনের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আভিভা ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটি ২৯০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা রাইট অফ করেছে। এর পরই রয়েছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (আইডিসিওএল) ও লংকা বাংলার অবস্থান। আইডিসিওএল রাইট অফ করেছে ২৬৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। লংকা বাংলা করেছে ২৬০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

এছাড়া আইডিএলসি ১৪৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা রাইট অফ (অবলোপন) করেছে। ফনিক্স ফাইন্যান্স ১১০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং উত্তরা ফাইন্যান্স রাইট অফ করেছে ১০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ৯৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা এবং প্রাইম ফাইন্যান্স ৮১ কোটি ২৫ লাখ টাকা রাইট অফ করেছে।

ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ৭৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা এবং সৌদি বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড এগ্রিকালচার ৭২ কোটি চার লাখ টাকা ঋণ রাইট অফ করেছে।

এ বিষয়ে আইডিএলসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এম জামাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এত পরিমাণ ঋণ রাইট অফ আইডিএলসি করেনি। তারপরও বিষয়টি সিএফও (প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা) ভালো বলতে পারবেন। আমি বিস্তারিত জেনে বলতে পারব।

লংকা বাংলা ফাইন্যান্স এর চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার শামীম আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঋণ রাইট অফ যেকোনো ব্যাংক এনবিএফআই এর জন্য একটি সাধারণ ঘটনা। লংকা বাংলা ফাইন্যান্স ২০২০ সালে ২৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক গাইডলাইন অনুসরণ করে পূর্ণ প্রভিশন সংরক্ষণ পূর্বক রাইট অফ করেছে। রাইট অফের কারণে আমাদের এই ঋণ আদায়ের প্রচেষ্টা কোনোরূপ ব্যত্যয় ঘটেনি। বরং আমাদের স্পেশাল এসেট ম্যানেজমেন্ট টিম আরো জোরের সঙ্গে এই রাইট অফ ঋণ আদায়ে সচেষ্ট আছে।

‘রাইট অফ আর্থিক খাতের জন্য খারাপ সংবাদ’ উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ঋণ অবলোপন বা রাইট অফের মাধ্যমে খেলাপি কমিয়ে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন কিছুটা ভালো দেখানো যায়। কিন্তু বাস্তব অর্থে এটি কোনো সুফল আনে না।’

যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ রাইট অফ করা হয়েছে আসলে তাদের কী অবস্থা সেটা দেখা দরকার— জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিষয়টি পর্যালোচনা করা উচিত। কারণ, ঢালাওভাবে রাইট অফ করার কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম 

খেলাপিদের গণছাড় না দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে সাবেক এ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘খেলাপি কমানোর জন্য প্রায় সময় নিয়ম-নীতির বিভিন্ন বিষয় শিথিলসহ বেশকিছু ছাড় দেওয়া হয়। এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের মূল কাজ হবে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করা। অন্যদিকে, বিতরণ করা ঋণ আদায়ে বেশি জোর দেওয়া। বিষয়টি নিশ্চিত করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।’

দেশে এখন ব্যাংকবহির্ভূত ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৫৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬৬ হাজার ৯৬২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। তবে, অবলোপন করা ঋণ হিসাব করলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

চলতি বছরের মার্চ শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৫৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ

‘রাইট অফ’ অর্থাৎ অবলোপনের মানে হলো, মন্দ ঋণগুলোকে মূল ব্যালান্সশিট থেকে সরিয়ে আলাদা আরেকটি লেজারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। ঋণ অবলোপনের মূল দুটো শর্ত হলো- ওই ঋণ সুদাসলে আদায়ের জন্য মামলা দায়ের করা এবং যে পরিমাণ ঋণ ‘রাইট অফ’ করা হয় তার সমপরিমাণ অর্থ ‘প্রভিশনিং’ বা ‘সঞ্চিতি’ করা। প্রভিশনিং মানে হলো ওই পরিমাণ অর্থ অন্য কাউকে ঋণ হিসাবে দেওয়া যাবে না।

এসআই/এমএআর/