৩ কারণে ‘দামের রাজা’ ইলিশ
মৌসুম শুরুর পর থেকে কিছুটা দেরিতে হলেও জেলেদের জালে জালে ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি ইলিশ ধরা পড়ছে। বাজারেও বরফের খাঁচায় শোভা পাচ্ছে মাছের রাজা ইলিশ। কিন্তু বাজারে গিয়ে দাম শুনে হোঁচট খাচ্ছেন ক্রেতারা। ভরা মৌসুমেও সাধারণ ক্রেতাদের ইলিশ কেনা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রতিবছরই বাড়ছে এ ইলিশের উৎপাদন।
ক্রেতাদের প্রশ্ন, ইলিশের উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে দামও কেন বাড়ছে। ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, মূলত তিন কারণে ইলিশের দাম ঊর্ধমুখি।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশের বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম, ক্রেতাদের অতিরিক্ত চাহিদা, সময় মতো জালে ইলিশ ধরা না পড়া এবং খুচরা বাজারে কৃত্তিম সঙ্কট তৈরি- এ তিন কারণেই খুচরা বাজারে দামের রাজা হয়ে উঠেছে ইলিশ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে চাঁদপুরের নদীকেন্দ্রে ইলিশের গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্প পরিচালক আবুল বাশার ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাইকারি বাজারে আপনি প্রচুর ইলিশ দেখবেন কিন্তু ঢাকাসহ বিভিন্ন খুচরা বাজারে কিনতে গেলে মনে হবে ইলিশের সরবরাহ কম। আসলে ইলিশের সরবরাহ কম না, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর দখলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ইলিশ চলে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এখন ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। এ সময়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইলিশ মজুতসহ বাজার ব্যবস্থাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে তারা।
এ ইলিশ গবেষক জানান, অক্টোবর মাস আসছে। ওই সময়ে মা ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে। এ সময় জেলেরা ইলিশ ধরতে সাগরে নামতে পারবেন না। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টা কিন্তু ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই জানেন। ফলে তারা অনৈতিকভাবে ইলিশ মাছ মজুত করে রাখে। পরবর্তী সময়ে বেশি দামে বাজারে বিক্রির আশায়।
রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি বাজারে সরেজমিনে খুচরা ইলিশ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেও তথ্য পাওয়া গেল, বাজারে ইলিশের ঘাটতি নাই, মূলত এক শ্রেণির ব্যবসায়ীই নিয়ন্ত্রণ করছে ইলিশের বাজার।
খুচরা বিক্রেতারা যা চাহিদা দেয় তার অনেক কম সরবরাহ করছে পাইকাররা- এমন দাবি করেন প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে ইলিশ বিক্রেতা সুরুজ মিয়া। তিনি বলেন, আমরা তো ইলিশ চাই ওনাদের (পাইকারদের) কাছে থেকে। কিন্তু ওনারা দেন না। বলেন যে, ঘাটতি আছে। ফলে বাজারেও একটা টান থাকে ইলিশের। এ কারণ দামও বাড়তির দিকে।
রাজধানীর উত্তরা এলাকার জহুরা মার্কেটের এ ইলিশ বিক্রেতার দাবি, সব ব্যবসাতেই একটা সিন্ডিকেট কাজ করে। আর ইলিশ তো সোনার হরিণ। এখানে সিন্ডিকেট থাকাটাই স্বাভাবিক। তারা যখন যে দামে কিনেন তখন সেরকম দামেই বিক্রি করার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যেও দুই একজন আছেন, কৃত্তিম সঙ্কট দেখিয়ে বেশি দামে ইলিশ বিক্রি করেন।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে ইলিশ নিয়ে গবেষণা করা বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (নদী কেন্দ্র) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিছুর রহমান মনে করেন, ইলিশের ক্রেতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। দাম বাড়ার এটাও অন্যতম কারণ।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে ড. আনিছুর রহমান বলেন, এখন তরুণ উদ্যোক্তারা অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সারাদেশে ইলিশ বিক্রি করছেন। ফলে চাহিদাও বাড়ছে। এছাড়া জেলেদের খরচসহ আনুষঙ্গিক সবকিছুর ব্যয়ও কিন্তু বাড়ছে। সে হিসেবে ইলিশের বাজারে একটু প্রভাব পড়তে পারে। তবে এখন সময় এসেছে ইলিশের বাজার ব্যবস্থা ও উৎপাদন কীভাবে আরও বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দেওয়ার।
এ ইলিশ গবেষক জানান, নদীর নাব্যতা বাড়ানোসহ আরও কিছু পদক্ষেপ নিলে ইলিশের উৎপাদন অনেক বেশি বাড়ানো সম্ভব।
অবশ্য ইলিশ বিক্রেতাদেরও দাবি, বাজারে বেশ ভালো চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে ক্রেতাদের অন্যতম পছন্দের তালিকায় ইলিশ যোগ হয়েছে। তাছাড়া এ সময়টাতেই ইলিশ মাছ বেশি কেনেন ক্রেতারা। সে অনুযায়ী বাজারে সরবরাহ কিছুটা কম। সব মিলিয়ে এরকম দাম হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, গতবারের চেয়ে এবার ইলিশের গতিপথেও কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এবার নদীর চেয়ে সাগরে ইলিশ ধরা পড়ছে বেশি। এছাড়া যে সময়ে ইলিশ ধরা পড়ার কথা সে সময়েও পড়ছে না। মাঝে-মধ্যে ইলিশ খরায় পড়ছে জেলেরা। বাজারে এটিরও একটা প্রভাব রয়েছে।
উদাহরণ টেনে তারা বলেন, দেখা যাচ্ছে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে অনেক বেশি ইলিশ ধরার পড়ার কথা কিন্তু সেটা পড়ছে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে। এতে বাজারের সরবরাহও ব্যহত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের বোঝাচ্ছেন, ভরা মৌসুমেও ইলিশ ধরা পড়ছে না। তাই দাম বেশি। কিন্তু যে সময়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ছে সে সময়ে আর তারা দাম কমাচ্ছে না।
রাজধানীর উত্তরাসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, আকারভেদে ইলিশ নানা দামে বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি ওজনের বেশি ইলিশ ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রামের ইলিশ ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় কিনছেন ক্রেতারা।
মৎস্য অধিদফতরের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ শাখা) মাসুদ আরা মমি ঢাকা পোস্টকে জানান, গত বছর সাড়ে ৫ লাখ টন ইলিশের আহরণ করা হয়। এর আগের বছরে (২০১৮-১৯) ৫ লাখ ৩৩ হাজার মে.টন ইলিশ জালে ধরা পড়ে। চলতি বছর ইলিশের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় পৌনে ৬ লাখ মেট্রিক টন।
একে/এসএম