ইভ্যালির বিরুদ্ধে ৫ হাজারের বেশি অভিযোগ
দেশের অন্যতম আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিরুদ্ধে ৫ হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা হয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে। এর মধ্যে বেশিরভাগ অভিযোগই টাকা পরিশোধ করে দীর্ঘদিন পণ্য না পাওয়ার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযোগ শুনানির কাজে নিয়োজিত অধিদফতরের প্রতিটি কর্মকর্তার রুমে ইভ্যালির বিরুদ্ধে ফাইলের স্তূপ জমেছে। গ্রাহকের স্বার্থ বিবেচনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এগুলোর নিষ্পত্তি করছে সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
বিজ্ঞাপন
অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হয়ে গ্রাহক জাতীয় ভোক্তা অধিদফতরে ১৩ হাজার ৩১৭টি অভিযোগ করেছেন। এসব অভিযোগের ১১ হাজার ৪৩৬টি বা ৮৬ শতাংশ নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
অধিদফতর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগের মধ্যে সব চেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে ইভ্যালির বিরুদ্ধে। গত জুন পর্যন্ত চার হাজার ৯৩২টি অভিযোগ পড়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। গত জুলাইয়ে আরও পাঁচ শতাধিক অভিযোগ আসে। চলতি আগস্টেও অভিযোগ আসছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ইভ্যালির বিরুদ্ধে সাড়ে পাঁচ হাজারে বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে এর বেশিরভাগই অর্থাৎ গত জুন পর্যন্ত ৮৪ শতাংশ নিষ্পত্তি করেছে অধিদফতর।
২০১৮ সালে যাত্রা শুরু হওয়া ইভ্যালি একটি বাংলাদেশ ভিত্তিক ই-কমার্স প্লাটফর্ম। লোভনীয় ডিসকাউন্ট কিংবা ক্যাশব্যাকের অফার প্রসঙ্গে ইভ্যালির নাম সর্বাগ্রে। স্বল্প সময়ে অনলাইন ক্রেতার মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও প্রতিষ্ঠানটি এখন গ্রাহক ভোগান্তি ও সমালোচনার শীর্ষে অবস্থান করছে।
জানা গেছে, সাইক্লোন, লণ্ডভণ্ড, ১৫ নম্বর অফার সতর্ক সংকেত এমন ভয়ঙ্কর নামে লোভনীয় অফার দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানায় ইভ্যালি। ওই টোপে পা দিয়ে এখন গ্রাহক পণ্যের জন্য টাকা দিয়ে এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
ভোক্তা অধিদফতর সূত্র জানায়, ইভ্যালি কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই নানা অভিযোগ আসছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ গ্রাহকের অভিযোগ ছিল অগ্রিম টাকা পরিশোধের পরও সময়মত হাতে এসে পৌঁছাচ্ছে না অর্ডার করা পণ্য। এখন এই তালিকায় যোগ হয়েছে আরও কিছু অভিযোগ। ইভ্যালির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (মার্চেন্ট) কেউ কেউ গ্রাহকদের পণ্য দিচ্ছে না। সরবরাহকারীরা বলছে, ভাউচারের বিপরীতে ইভ্যালি তাদের পাওনা পরিশোধ করেনি। আবার চেক দিলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে টাকা না থাকায় সেই চেক ব্যাংকে জমা দিতে নিষেধ করছে ইভ্যালি। এমন হয়রানির শিকার হয়ে অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেছেন ভোক্তা অধিদফতরে।
এমনই একজন আসিফ খান। তিনি জানান, গত এপ্রিল দুটি বাইক অর্ডার করে আড়াই লাখ টাকা মূল্য পরিশোধ করেন। ৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে বাইক দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত দেয়া হয়নি। মূল্যও পরিশোধ করেনি। দুইবার তাদের অফিস গিয়েছিলাম, অফিস বন্ধ। অনেকবার তাদের কল সেন্টারে ফোন দিয়েছি। লাভ হয়নি। এখন বাধ্য হয়ে ভোক্তা অধিদফতরে অভিযোগ করেছি।
ইভ্যালিতে পণ্য অর্ডার করে বিপাকে আছেন সামীম আরাফাত নামের এক গ্রাহক। তিনি জানিয়েছেন, গত ৬ মার্চ অর্ডার ২০ এপ্রিল পিকড হয়েছে। এখনো ডেলিভারি হয়নি। ৪৫ কর্মদিবস তারা কীভাবে গণনা করে সেটা তারাই জানে। ১৬ মে তে দুটি অর্ডার করেছি। এর মধ্যে একটি অর্ডার হচ্ছে (অনেকগুলো গ্রোসারি আইটেম)। ৬ জুন পিকড কিন্তু ডেলিভারির কোনো খবর নেই। গ্রোসারি আইটেম সবচেয়ে তাড়াতাড়ি ডেলিভারি দেওয়ার কথা। তারা দিচ্ছে না।
তিনি আরও জানান, গ্রোসারি ডেলিভারিতে এত সময়। আর কোনো ই কমার্সে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। এছাড়া ১৬ মার্চ এর মোবাইল ফোনের ডেলিভারি দেওয়ার কোনো খবর নেই। আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না। কল দিলে পাওয়া যায় না। মেসেজ দিলে তাদের সার্ভারের কাজ হচ্ছে। এছাড়া মেসেজ এ উওর একটাই পেয়ে যাবেন খুব শিগগিরই। মেসেজ ইমেইল করে কোনো লাভ হয়নি। অনেক বার বলেছে যোগাযোগ করবে কিন্তু করেনি। ১০ দিনে গ্যারান্টেড ডেলিভারি দেওয়ার কথা বলে ১ মাসেও এখন সে পণ্য দেয় না। প্রায়োরিটি স্টোরের ডেলিভারি পর্যন্ত এক মাস লাগিয়ে দেয়। প্রতিশ্রুতির কোনো দামই নেই তাদের কাছে। তাদের আর কত সুযোগ দেব আমরা?
সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে উদ্দেশ্য করে এ ভোক্তা বলেন, ইভ্যালির বিরুদ্ধে এখন থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেন। না হয় পরে ই-অরেঞ্জ এর মত অবস্থাই হবে। এর চেয়ে খারাপও হতে পারে।
এ বিষয়ে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেলের কাছে জানতে চাইলে তিনি কিছু বলেননি। লিখিত প্রশ্ন করা হলেও কোনো উত্তর দেননি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে মোহাম্মদ রাসেল জানান, গ্রাহকদের অর্ডার অথবা রিফান্ড কিছুটা বিলম্ব হলেও অবশ্যই পেয়ে যাবেন, সময় দিন, ইভ্যালির ভেলকি পজিটিভলি যেকোনো সময় দেখতে পারবেন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) বাবলু কুমার সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো লোভনীয় অফার দিচ্ছে সাধারণ গ্রাহকরা। গ্রাহকরা তাদের সেই ফাঁদে পা দিয়ে বিপদে পড়ছে। আমাদের এখানে ই-কমার্সের যেসব অভিযোগ এসেছে তার বেশিরভাগই ইভ্যালির বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির কোনো পণ্য উৎপাদন করে না কিন্তু ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়েছে। বেশিরভাগ গ্রাহক পণ্য অর্ডার করে মূল্য পরিশোধ করেও পণ্য পাচ্ছে না। আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ আসছে আমরা তা দ্রুত নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করছি। আইন অনুযায়ী শাস্তি ও জরিমানা করছি।
তিনি জানান, ই-কমার্সের প্রতারণা কমাতে হলে প্রথমে গ্রাহককে সতর্ক হতে হবে, ভোক্তারা পণ্য কেনার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জেনে বুঝে অর্ডার করতে হবে। পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করে ব্যবসা করছে তাদের দ্রুত নিয়মনীতির মধ্যে আনার পরামর্শ দেন অধিদফতরের এ মহাপরিচালক।
এদিকে ১২ আগস্ট দেনা-পাওনা ও সম্পদের হিসাব দেওয়ার জন্য তিনটি ধাপে সময় দিয়ে ইভ্যালির চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ১৯ আগস্টের মধ্যে সম্পদ ও দায় বিবরণী, ২৬ আগস্টের মধ্যে মোট গ্রাহক ও গ্রাহকের কাছে দেনার পরিমাণ এবং ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মার্চেন্টদের কাছে দেনার পরিমাণ জানাতে বলা হয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সম্পদ ও দায়ের হিসাব জমা দিয়েছে ইভ্যালি। এতে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তার নিজের ব্র্যান্ড মূল্য ৪২৩ কোটি টাকা। গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাদের মোট দায় ৫৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেল কোম্পানিকে দিয়েছেন। বাকি ৫৪৩ কোটি টাকা হচ্ছে কোম্পানিটির চলতি দায়।
ইভ্যালি জানিয়েছে, দায়ের বিপরীতে তাদের চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে স্থাবর সম্পত্তি দাঁড়ায় ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
মোট দায় ৫৪৪ কোটি টাকা থেকে স্থাবর সম্পত্তি ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বাদ দিলে বাকি থাকে ৪৩৯ কোটি টাকা, যাকে ইভ্যালি বলছে তার অস্থাবর সম্পত্তি।
বিবরণী মেলাতে ইভ্যালি দেখিয়েছে, অস্থাবর সম্পত্তি ৪৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ৪২৩ কোটি টাকা হচ্ছে তার ব্র্যান্ড মূল্য, আর ১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা হচ্ছে অদৃশ্যমান সম্পত্তি।
সব মিলিয়ে ইভ্যালির মোট দেনার পরিমাণ ৫৪২ কোটি ৯৯ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮২ টাকা। এই দেনার বিপরীতে তাদের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য মোট সম্পদ রয়েছে ৫৪৩ কোটি ৯৯ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮২ টাকা।
এর আগে, ১৯ জুলাই এসব তথ্য জানাতে ইভ্যালিকে চিঠি দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। জবাবে দায়-দেনার তথ্য ও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে ছয় মাস সময় চেয়ে গত ১ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির উত্তর দেয় ইভ্যালি।
ইভ্যালিকে দেওয়া কারণ দর্শানোর নোটিশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছিল, গত ১৪ মার্চ পর্যন্ত গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে মোট ৪০৭ কোটি টাকা দায়ের বিপরীতে ইভ্যালির কাছে মাত্র ৬৫ কোটি টাকার চলতি সম্পদ কেন? বাকি টাকা ইভ্যালির কাছে থাকলে বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে, না থাকলে পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে হবে।
এছাড়া ১৫ জুলাই পর্যন্ত গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে দায় এবং তা পরিশোধের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ব্যবসা শুরুর পর গ্রাহকদের কাছ থেকে ইভ্যালি কত টাকা নিয়েছে, মার্চেন্টদের কত টাকা পরিশোধ করেছে এবং প্রশাসনিক ও অন্যান্য খাতে কত টাকা ব্যয় করেছে, তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ জানাতে বলা হয় নোটিশে।
এর আগে ১৭ জুলাই ইভ্যালির পেমেন্ট স্থগিত করে বিকাশ। ওই সময় বেশ কিছু ব্যাংকও ইভ্যালির সঙ্গে তাদের ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের লেনদেন স্থগিত করে। এর মধ্যে ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি), ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা ব্যাংক, ইউসিবি ও সিটি ব্যাংক ছিল। এছাড়া ইভ্যালির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বেশকিছু পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাউচারের বিপরীতে পাওনা অর্থ পরিশোধ না করায় তারা বিক্রি বন্ধ করে দেয়। ইভ্যালির গিফট ভাউচারে কেনাকাটার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞপ্তিও দেয়।
তবে গত ১৭ আগস্ট ইভ্যালির পেমেন্ট চালু করেছে বিকাশ। এছাড়া ইউসিবি ব্যাংকের উপায়, এসএসএল কমার্জ এবং ভিসা মাস্টার কার্ডেও ইভ্যালির পেমেন্ট করা যাচ্ছে।
এসআই/এসএম